বিজেপি শাসিত ভারতীয় রাজনীতিতে গরু এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। গরু যতটা না ধর্মীয় কারণে গুরুত্বপূর্ণ ভারতে মোদি সরকার আসার পর গরুর রাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক বেড়ে যায়। ধর্মকে উপজীব্য করে রাজনীতি করা বিজেপির অনেক নেতাকর্মীর সাথে এবার গরুর পক্ষে দাঁড়ালেন ভারতীয় এক বিচারপতি।
পৃথিবীর সব প্রাণী নিঃশ্বাসে অক্সিজেন নিয়ে প্রশ্বাসের মাধ্যমে দূষিত কার্বন ডাই-অক্সাইড বের করে দিলেও ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক বিচারপতির দাবি, এক্ষেত্রে গরু আলাদা। তিনি বলছেন, গরুই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী যারা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেন নিয়ে প্রশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেনই ত্যাগ করে। খবর টাইমস অব ইন্ডিয়ার।
শেখর কুমার যাদব নামের ওই বিচারপতিই সম্প্রতি গোহত্যার এক মামলায় এক ব্যক্তির জামিন আবেদন নাকচ করে দেন ও গরুকে ভারতের জাতীয় পশু ঘোষণা করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
জামিন নাকচের ওই একই আদেশে বিচারপতি আরও বলেছেন, ভারতে একটি প্রথা রয়েছে যে, যেকোনো পূজার আয়োজনে ঘি ব্যবহার করা হয়, যা তৈরি হয় গরুর দুধ থেকে। আর এই ঘি সূর্যরশ্মিকে বিশেষ এক শক্তি দেয়, যা শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত ঘটায়।
বিচারপতি যাদব গরুর শ্বাসযন্ত্রের যে অনন্য বৈশিষ্ট্য ও অসাধারণ গুণাবলী থাকার দাবি করেছেন, উত্তরখন্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিংও একসময় এই ধরনের কথাবার্তা বলেছেন। ২০১৯ সালে এক বিবৃতিতে ত্রিবেন্দ্র সিং বলেছিলেন, গরুই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা প্রশ্বাসের মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ না করে অক্সিজেন ত্যাগ করে।
গরুর দুধ, দই, ঘি, গোমূত্র এবং গোবর থেকে তৈরি পঞ্চগব্য বেশ কিছু রোগ নিরাময়ে সহায়ক বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ওই আদেশে।
আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দিব্যনন্দ সরস্বতীকে উধ্বৃত করে বিচারপতি যাদব আরও বলেন, একটি গাভীর দুধে ৪০০-এর বেশি মানুষ উপকৃত হয়, কিন্তু একটি গরুর মাংস মাত্র ৮০ জন মানুষ খেতে পারে। যিশু বলেছেন, একটি গরু বা ষাঁড়ের প্রাণ নেয়া একটা মানুষ হত্যার মতোই অপরাধ।
আদেশে আরও বলা হয়েছে, যেহেতু গরু ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ তাই এর মাংস খাওয়া এ দেশের কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলে বিবেচিত হতে পারে না। গরুকে ভারতের জাতীয় পশু বলে ঘোষণা দেয়ার দাবিতে সংসদে আলোচনা শুরুরও তাগাদা দেন বিচারপতি। একইসঙ্গে বলেন, যারা গরুর ক্ষতি করার কথা বলেন তাদের ঠেকানোর জন্য ব্যবস্থা থাকা উচিত।
আদেশে আরও বলা হয়েছে, বেঁচে থাকার অধিকার অবশ্যই হত্যার অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারো স্বাদের আনন্দের জন্য কোনো জীবন কেড়ে নেয়া যেতে পারে না।
তবে এই প্রথম নয়, গরুকে নিয়ে মন্তব্য করে আগেও বিতর্কে জড়িয়েছেন ভোপালের বিজেপি সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞা। নির্বাচনী প্রচারণাকালে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলাম। গোমূত্র পান করে আর পঞ্চগব্য (গোবর, গোমূত্র ও দুধ থেকে প্রস্তুতকৃত এক ধরনের খাবার) গ্রহণ করে নিজেকে সারিয়ে তুলেছি। এটা সত্যিই কার্যকরী এবং আমি নিজেই তার উদাহরণ।’
তিনি দাবি করেন, শুধু গাভীর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তিনি আরও বলেন, ‘যদি আপনি গাভীর পেছন থেকে গলার দিকে হাত বুলিয়ে দেন, তাহলে গোমাতা খুশি হন। আর এটা নিয়মিত করতে থাকলে আপনার ব্লাড প্রেসারও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’
তবে মন্ত্রী/বিচারপতির দাবির উল্টো কথা বলছে জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিক এই সংগঠনটির খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও) একটি প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, সমাজে গরু উপকারী প্রাণী। কিন্তু গরুর পাচনতন্ত্রের মাধ্যমে বাতাসে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। গরুসহ অন্যান্য গৃহপালিত পশু ১৮ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একটি গরু বছরে ৭০ থেকে ১২০ কিলোগ্রাম মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে। এই মিথেন একটি গ্রিনহাউজ গ্যাস। কার্বন ডাই-অক্সাইডের ২৩ গুণ বেশি ক্ষতিকর এই মিথেন। এর ক্ষতির কার্যকারিতা এক বছরে ২৩০০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইডের সমান।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দাবি, খোলা বাতাসে ১০০০ লিটার পেট্রল পুড়লে যে দূষণ হয়, একটি গরু বছরে সেই পরিমাণ মিথেন উৎপন্ন করে।
জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একটি গাড়ি এক বছরে বাতাসে যা দূষণ করে, তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপন্ন করতে পারে একটি গরু।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় আসার পর অনেক স্থানেই গরু জবাই, গরুর মাংস ক্রয়-বিক্রয় ও খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কাছে গরু পবিত্র প্রাণী বলে পরিচিত হলেও, বর্তমানে এটি ভারতের একটি রাজনৈতিক ইস্যু। আর এই গরুর মাংস খাওয়া ও গরু জবাইয়ের ‘অভিযোগে’ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও সামনে এসেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৯
আপনার মতামত জানানঃ