গত আগস্ট মাসে অন্তত ছয়জন সাংবাদিক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন। আর এই সময়ে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ২৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ও মানহানির। এ ছাড়া চারজন সাংবাদিককে হেনস্থা ও হুমকি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মিডিয়া মনিটরিং রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিএফইউজে মনিটরিং সেল দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। বিএফইউজের সভাপতি এম আবদুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকনের তত্ত্বাবধানে এ মনিটরিং সেল কাজ করছে। মনিটরিং কমিটিতে রয়েছেন বিএফইউজের সহসভাপতি রাশিদুল ইসলাম (আহ্বায়ক), সহকারী মহাসচিব মো. সহিদ উল্লাহ মিয়াজী (যুগ্ম আহ্বায়ক) ও প্রচার সম্পাদক মাহমুদ হাসান (সদস্য সচিব)।
বিএফইউজে দাবি করেছে, আগস্টে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিধিনিষেধের মুখে পড়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে কর্মরত সংবাদিক ও মানিকগঞ্জে সরকারি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া সংবাদকর্মীরা।
এ সময়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে ঢাকা, কুমিল্লা, নরসিংদী, টাঙ্গাইল ও চুয়াডাঙ্গায়। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গার সাংবাদিক সোহেল রানা ডালিম, কুমিল্লার বুড়িচংয়ে যুগান্তরের সাংবাদিক ইকবাল হোসেন সুমন এবং নরসিংদীর মনোহরদিতে চ্যানেল আই প্রতিনিধি সুমন রায়কে রক্তাক্ত ও গুরুতর আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। কুমিল্লার ঘটনায় চার হামলাকারী গ্রেপ্তার হলেও অন্য ঘটনায় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
আগস্ট মাসে মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, কালের কন্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, ডেইলী সান সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরী, ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়ার এমডি সায়েম সোবহান আনভির, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ, যমুনা টেলিভিশনের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান প্রতিবেদক রয়েছেন বলেও বিএফইউজে জানিয়েছে।
আগস্ট মাসে জুলাইয়ের চেয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা কম ছিল বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। জুলাইয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ছয়জন সাংবাদিক। ডিজিটাল আইনে ১০ জনসহ বিভিন্ন মামলায় ওই মাসে আসামি করা হয়েছিল ১১ জন সাংবাদিককে। এ ছাড়া হামলা, হেনস্থা ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন আরও সাতজন সংবাদকর্মী।
দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কখনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, কখনোবা প্রশাসন এসবের পেছনে থাকে। কিন্তু এগুলোর বিচার না হওয়ায় দেশে এমন নিপীড়নের ঘটনা ঘটতেই থাকে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কখনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, কখনোবা প্রশাসন এসবের পেছনে থাকে। কিন্তু এগুলোর বিচার না হওয়ায় দেশে এমন নিপীড়নের ঘটনা ঘটতেই থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণের বেড়ে যাওয়ায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এ পেশার অনেকেই। আইনের দীর্ঘসূত্রিতা, জটিল বিচারিক প্রক্রিয়া সেইসঙ্গে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোন ধরণের সহযোগিতা না থাকার কারণে সাংবাদিক নির্যাতন ও সহিংসতা থামানো যাচ্ছে না। সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় কোন প্ল্যাটফর্ম না থাকায় এই পেশা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলেও মন্তব্য করেন তারা।
তারা বলেন, সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হলেও সেগুলো আদালতে নিতে চান না। কেননা মামলা করতে গেলে প্রতিষ্ঠান থেকে যে সাপোর্ট লাগে বা অর্থনৈতিকভাবে যে সাপোর্ট লাগে, সেটা তাদের সবার থাকেনা। এ অবস্থায় বিচার নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়। বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও রাষ্ট্রীয় সামাজিকভাবে সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়নি বলে জানান তারা।
তারা বলেন, এ দেশে মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। সাংবাদিকদের জীবনও নিরাপত্তাহীন। কাজ করতে গিয়ে মামলা-হামলার শিকার হতে হয় তাদের। স্বাধীন দেশে এটা মেনে নেওয়া যায় না। সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা এ দেশে নেই। একের পর এক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু বিচার হয় না। এভাবে চলতে পারে না।
তারা বলেন, সরকারের কাছে বলতে বলতে সাংবাদিকেরা ক্লান্ত। দেশের প্রতিটি বিভাগে, থানায় সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। সাংবাদিকদের কলম ভেঙে দেওয়া সহজ নয়। খুন, গুম, নির্যাতনের শিকার হওয়া সাংবাদিকদের ঘটনার বিচার করতে হবে।
আরও বলেন, রক্তের দাগ শুকিয়ে যাবে, কবরে ঘাস গজাবে, মানুষও সাংবাদিকতা পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত মানুষদের ভুলে যাবে। যদি সংবাদপত্রের কাগজগুলো সাদাই থাকত, টেলিভিশনের পর্দা দিনরাত ঝিরঝির করত আর অনলাইন পোর্টালগুলোতে লেখা থাকত ‘৪০৪ সিস্টেম এরর’—তাহলে হয়তো সাংবাদিকতার জরুরত মালুম হতো অনেকের। সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনকে তখন এতটা ‘স্বাভাবিক’ মনে হতো না। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে সে উপায়ও নেই গণমাধ্যমের। একদল সাংবাদিক তবু পেশাগত পবিত্রতা মাথায় নিয়ে পবিত্র প্রাণীর মতো অপঘাতের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যান। পরাজয় জেনেও যিনি লড়াই করে যান, তাকেই বলে সংশপ্তক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখন সংশপ্তক পর্ব পার করছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০১
আপনার মতামত জানানঃ