প্রায় চারশ বছর আগে, ষোল শতকে আফ্রিকায় গড়ে ওঠে এক রাজ্য, দাহোমি রাজ্য। নারী যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত ‘দাহোমি আমাজন’ সৈন্যদলের জন্য এই রাজ্য ইতিহাসের পাতায় সুপরিচিত। আগুজি যোদ্ধাদল, মিনো ইত্যাদি নামে নারীদের এই সেনাদল পরিচিত। দাহোমি আমাজনই আধুনিক ইতিহাসের একমাত্র নারী সেনাবাহিনী।
বর্তমান আফ্রিকার দেশ বেনিনে অবস্থিত ছিল দাহোমি। দাস ব্যবসার মাধ্যমে এ রাজ্য ধনী হয়ে ওঠে। ঠিক কখন এবং কেন দাহোমিরা তাদের প্রথম নারী সৈন্য নিয়োগ দেয় সে ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। সবচেয়ে প্রচলিত মতানুসারে দাহোমি সাম্রাজ্যের তৃতীয় রাজা ওয়েগবাজা হাতি শিকারের জন্য নারীদের সমন্বয়ে এই সৈন্যদল গঠন করেন, যাদের দলকে বলা হত জিবেতো।
আমাজনদের ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য দশকের পর দশক ধরে গবেষণা করছেন ইউরোপ ও পশ্চিম আফ্রিকার গবেষকরা। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের তলায় এই বীর নারীদের প্রকৃত ইতিহাস অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে।
ইতিহাস সবসময়ই লেখা হয় বিজয়ীদের হাতে। আমেরিকান শিশুদেরকে স্কুলে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আবিষ্কারের কথা পড়ানো হয়। কিন্তু তিনি যে আমেরিকার ভূমিপুত্রদের পায়ে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস কোনো স্কুলে পড়ানো হয় না।
১৯৮৪ সালে বর্তমান দক্ষিণ বেনিন দখল করে নেয় ফ্রান্স। তার পরপরই ফরাসি ঔপনিবেশিকরা অনন্য নারী যোদ্ধাদের সেনাদল ভেঙে দেয়। এরপর আমাজনদের চিরতরে মুছে ফেলে ইতিহাসের পাতা থেকে। সমস্ত বইপত্র থেকে মুছে ফেলা হয় আমাজনদের নাম। বেনিনের বর্তমান প্রজন্মের বহু মানুষ তাদের পূর্বমাতাদের সম্পর্কে জানে না।
বেনিনের একদল গবেষক এখন তাদের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। ফ্রান্সের সঙ্গে দু-বছরব্যাপী যুদ্ধের পর মাত্র ৫০ জন নারী যোদ্ধা বেঁচে ছিলেন। সেই পঞ্চাশ জনের সর্বশেষ যোদ্ধা মারা যান ১৯৭০-এর দশকে।
আমাজনদের বংশধরদের খুঁজে বের করতে গবেষকরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। এই প্রকল্পের গবেষক সার্জ ওউইতোনা বলেন, ‘তাদের গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। আমাজনরা ছিলেন ভীষণ ক্ষমতাধর। প্রভাবশালী ছিলেন তারা। কিন্তু ঔপনিবেশিক বিজয়ের পর সবাই তাদের নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।’
দাহোমি আমাজনদের ইতিহাস
অন্তত তিন শতাব্দী পশ্চিম আফ্রিকায় প্রবল দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে দাহোমি। এই রাজ্যকে তুলনা করা হয় স্পার্টার সঙ্গে। ইউরোপীয় পর্যটকরা এই দাহোমির নারী যোদ্ধাদের ‘নারী-সৈনিক’, ‘মেডুসা’, ‘চিরকুমারী যোদ্ধা’ এসব নামে ডাকত। তবে শেষ পর্যন্ত একটা নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন এই নারীরা— আমাজন।
অন্তত তিন শতাব্দী পশ্চিম আফ্রিকায় প্রবল দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে দাহোমি। এই রাজ্যকে তুলনা করা হয় স্পার্টার সঙ্গে। ইউরোপীয় পর্যটকরা এই দাহোমির নারী যোদ্ধাদের ‘নারী-সৈনিক’, ‘মেডুসা’, ‘চিরকুমারী যোদ্ধা’ এসব নামে ডাকত। তবে শেষ পর্যন্ত একটা নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন এই নারীরা— আমাজন।
ইউরোপিয়ান রেকর্ড অনুযায়ী কার্যকারীতা ও সাহসের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের উচ্চতর হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
একটি তত্ত্ব অনুযায়ী তারা হাতি শিকার বাহিনীর অন্তভুক্ত ছিলো। তাদের স্বামীরা যখন অন্য আদিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো তখন তারা নিজেদের দক্ষতা দিয়ে দাহোমি রাজাকে আকৃষ্ট করে। অন্য একটি তত্ত্ব মতে, যেহেতু তারা নারী সেহেতু একমাত্র তারাই রাজার প্রাসাদে প্রবেশের অনুমতি পেতো। যার ফলে তারা রাজার দেহরক্ষীতে রূপান্তরিত হয়।
এ দুটোর যেটাই সত্য হোক, প্রশিক্ষণে কেবল শক্তিশালী-স্বাস্থ্যবান ও সাহসী নারীদের নিয়োগ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের যুদ্ধপাগল হত্যাকারী হিসেবে তৈরি করা হতো যারা তিন শতাব্দি ধরে সমগ্র আফ্রিকায় দাপট চালিয়েছে।
তাদের যুদ্ধসামগ্রী হিসেবে শিরস্ত্রাণ ও চাপাতি দেওয়া হতো। ঊনবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে তারা রাজার প্রতি দারুণ অনুগত ও ভীষণ যুদ্ধপ্রিয় হয়ে ওঠে। মাত্র আট বছর বয়স থেকেই বাহিনীতে মেয়েদের নিয়োগ দেওয়া হতো, হাতে তুলে দেওয়া হতো অস্ত্র।
একদিকে সমাজের এক শ্রেণীর নারীরা স্বেচ্ছায় সৈন্যবাহিনীতে আসতে লাগলো, অন্যদিকে বাকি নারীদের স্বামীরা নিজেরাই তাদের স্ত্রীদের বাহিনীতে ভর্তি করতেন এবং নিজেদের বেপরোয়া স্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি বলে অভিযোগ করতো।
প্রশিক্ষণের শুরু থেকেই তাদের শক্তিশালী, নির্মম ব্যথা সহ্য করার অধিকারী হতে শেখানো হতো। লাফ দেওয়া, কাঁটাযুক্ত গাছে চড়ার পাশাপাশি হাঙ্গার গেম নামক একটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। হাঙ্গার গেম হলো দশ দিনের জন্য তাদের জঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। সঙ্গে কেবল অস্ত্র ছাড়া খাবার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দেওয়া হতো না। এখানে তাদের প্রমাণ করতে হতো যে তারা পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ শক্তিশালী।
যুদ্ধে পরাজয় হলে যদি রাজা তাদের আশ্রয় না দেন তাই মৃত্যুদণ্ডই ছিলো তাদের জন্য একমাত্র পথ। দাহোমি নারী যুদ্ধ করবে নয়তো মরবে, পরাজয় বলে কিছু নেই।
রাজার সঙ্গে আমাজনদের একধরনের আনুষ্ঠানিক বিয়ে দেওয়া হতো। তবে এদের কারও সঙ্গে রাজার কোনো শারীরিক সম্পর্ক হতো না বলে বেশিরভাগ নারী যোদ্ধাই আজীবন কুমারী থেকে যেতেন। যুদ্ধ করতে যাতে কোনো ঝামেলা না হয়, সেজন্য সন্তান নেওয়াও নিষেধ ছিল আমাজনদের।
উনিশ শতকের প্রথম দশকে দাহোমির নারী সেনাদলের সদস্যসংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই নারী যোদ্ধারা শত্রুরাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দিতেন। যুদ্ধ শেষ হলে পরাজিত বন্দীদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হতো।
ফরাসিদের আক্রমণের পর এই ঐতিহ্য শেষ হয়ে যায়। এক ফরাসি জেনারেল লেখেন, যুদ্ধের ময়দানে এই নারী যোদ্ধারা বিপুল সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
ঐতিহাসিকদের ধারণা, ফরাসিদের হাতে প্রায় ২ হাজার আমাজন হত্যার শিকার হন। বেঁচে যান মাত্র ৫০ জনের মতো যোদ্ধা। কালের পরিক্রমায় তারাও একসময় হারিয়ে যান ইতিহাসের গহ্বরে। খোদ দাহোমির রাজধানী আবোমিতেই বিস্মৃত হয়ে যান তারা।
দাহোমি আমাজনের বিশেষত্ব
দাহোমির নারী যোদ্ধারাই যে তাদের সময়ের একমাত্র নারী ছিলেন যারা সামরিক কাজে অংশ নিয়েছেন তা কিন্তু নয়। কিছু সংখ্যক সমসাময়িক নারী শাসক, নারী দেহরক্ষীর ঘটনা জানা যায়। কিন্তু দাহোমি আমাজনের বিশেষত্ব হলো তাদেরকে প্রস্তুত করার ধরণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ। পুরুষদের মতোই কঠোর প্রশিক্ষণ দেয়া হত তাদের। নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম ছিল।
তারা কেবল অন্দরমহল কিংবা প্রাসাদের রক্ষী হিসেবে থাকত না, যুদ্ধের ময়দানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করত। রাজ্য ও রাজার জন্যে যুদ্ধ করা ও প্রায়শঃ জীবন দেয়াই দাহোমির নারী যোদ্ধাদের বাকীদের চেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড় করায়। উনিশ শতকের শেষে অর্ধেকেই অন্তত ৬ থেকে ১৫ হাজার দাহোমি আমাজনের মৃত্যু ঘটে বিভিন্ন যুদ্ধে। তাদের দেয়া প্রশিক্ষণ ছিল তাদের স্নায়ুকে ইস্পাতের মতো কঠিন করে গড়ে তোলার জন্য। প্রায়ই প্রশিক্ষণার্থীদের পরীক্ষা করা হতো যুদ্ধবন্দীদের শাস্তি দেয়ানোর মাধ্যমে।
এমনকি নারী যোদ্ধারা বন্দী হত্যায়ও নিয়োজিত ছিল। এক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হত তাদের, যার নাম ছিল ‘অসংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ’। এই প্রশিক্ষণে এক বাৎসরিক অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষণার্থী যোদ্ধারা ১৬ ফুট উঁচু একটি বেদীতে দাঁড়িয়ে ঝুড়িতে বাঁধা অবস্থায় একজন করে যুদ্ধবন্দী নিয়ে নিচে দাঁড়ানো জনতার ভীড়ে ছুড়ে মারত। বেশিরভাগ সময়েই মৃত্যু ঘটতো বন্দীর।
রাজার সৈনিক হিসেবে তারা দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও নির্মম হতে শিখতো। যদিও তারা হিংস্র ও নির্মম নারী বলে পরিচিত, তবুও আফ্রিকায় নারীদের বর্তমান সম্মানজনক অবস্থানের জন্য তাদের কৃতীত্ব অনেকখানি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ