![](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2020/11/corona-waste-300x169.jpg)
- মুখবন্ধ ব্যাগে না ভরেই মেডিকেল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ডাস্টবিনে
- মেডিকেল বর্জ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকির শিকার ৫২ লাখ মানুষ
- প্রতিদিন করোনা বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে ২৮২ দশমিক ৪৫ টন
- মাত্র ৬ দশমিক ৬ ভাগ সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায়
- ৯০ শতাংশই প্লাস্টিক বর্জ্য বিধায় পরিবেশের ক্ষতি
- পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য নেই আলাদা গাইডলাইন
- চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালার বাস্তবায়ন নেই
ঢাকা শহরে এখন এমন কোনো সড়ক পাওয়া দায়, যেখানে মাস্ক, গ্লাভস, ফেসশিল্ড ইত্যাদি বর্জ্যের দেখা মিলবে না। এমনকি পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্টের (পিপিই) মতো সংবেদনশীল সুরক্ষা সামগ্রীও ফেলা হচ্ছে যেখানে-সেখানে। বায়োসেফটিক্যাল (জৈবসুরক্ষামূলক) ব্যাগে না ভরেই মেডিকেল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ডাস্টবিনে। বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার আগস্ট মাসের গবেষণা প্রতিবেদনমতে, সব মিলিয়ে প্রতিদিন এ ধরনের বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে ২৮২ দশমিক ৪৫ টন। যার পুরোটাই অপসারণ করা হচ্ছে গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে। এতে যেমন সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা বাড়ছে, তেমনি পরিবেশও পড়ছে হুমকিতে। কারণ করোনাসহ মেডিকেল বর্জ্যের অধিকাংশই প্লাস্টিকজাত। খোলা জায়গায় ফেলার কারণে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য পঁচতে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক-এর এই গবেষণা অনুযায়ী, সুরক্ষা সামগ্রী বর্জ্যের মাত্র ৬ দশমিক ৬ ভাগ সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসছে। তবে এ চিত্রকে পূর্ণাঙ্গ বলা কঠিন। কারণ, ঢাকায় শুধু হাসপাতাল নয়, করোনা বর্জ্যের বড় একটি অংশ আসছে বাসাবাড়ি, শপিংমল বা বেসরকারি অফিস থেকে।জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বর্জ্য সাবধানে এবং নির্দিষ্ট উপায়ে নষ্ট না করলে তা সংক্রমণ বাড়াতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে সচেতন নন কেউ। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্যও নেই আলাদা গাইডলাইন বা প্রশিক্ষণ। এসব কারণে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়াও কঠিন।
মেডিকেল বর্জ্যকে ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে ২০০৮ সালে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিধিমালা করা হয়েছিল। যদিও তা এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৮ সালের জাতীয় পরিবেশ নীতিতেও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সব বর্জ্যের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী, মেডিকেল বর্জ্যগুলো অটোক্লেভস মেশিনের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করে তা বায়োহ্যাজার্ড ব্যাগে ভরে রাখার কথা। যদিও অধিকাংশ হাসপাতালই মেডিকেল বর্জ্য জীবাণুমুক্ত করে বায়োসেফটিক্যাল ব্যাগে ভরে রাখছে না। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘প্রিজম বাংলাদেশ’ হাসপাতালগুলো থেকে মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহে কাজ করে। তবে বাসাবাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য সংগ্রহে পৃথক ব্যবস্থাপনা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে করোনাভাইরাসে ২২ নভেম্বর ২০২০, রোববার পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছেন চার লাখ ৪৭ হাজার ৩৪১ জন। আইইডিসিআরের হিসাব বলছে, দেশের মোট আক্রান্ত রোগীর ৫৭ শতাংশই ঢাকা মহানগরের বাসিন্দা। আবার রোগীদের একটা বড় অংশই চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় অবস্থান করে। এভাবে প্রতিদিনই রোগী ও নাগরিকদের ব্যবহৃত কোভিড সুরক্ষা সামগ্রী থেকে উৎপন্ন হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য, যা সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে পড়ছে নানা স্থানে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও র্যাবিস ইন এশিয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বেনজির আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ১০ কোটি মানুষ যদি দিনে একটি করেও মাস্ক-গ্লাভস ব্যবহার করেন, তাহলে ১০ কোটি বর্জ্য হচ্ছে। এমনকি এটা এক কোটি হলেও বিশাল। জীবাণুবাহী এসব বর্জ্য ড্রেন, রাস্তা ও নদীতে পড়লে সংক্রমণ হবে না, এমনটা বলা যাবে না। তাই এসবের ব্যবস্থাপনায় কর্তৃপক্ষের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়োগ ও প্রতিরোধ টিম করা উচিত। বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়া যাবে না।
করোনাভাইরাস উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর শুধু এক মাসে মাস্ক-গ্লাভসসহ সংশ্নিষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ টন। শুধু ঢাকায় উৎপাদন হয়েছে তিন হাজার ৭৬ টন, যার বড় একটি অংশ মাটি ও পানিতে মিশছে। সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এসডোর জরিপ অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ঢাকায় প্রতি মাসে সার্জিক্যাল মাস্ক থেকে ৪৪৭ টন, পলিথিন গ্লাভস থেকে ৬০২ টন, সার্জিক্যাল গ্লাভস থেকে এক হাজার ৩১৪ টন ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ২৭০ টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া ফেসশিল্ড, গগলস, পিপিই, সাধারণ মাস্ক থেকেও উল্লেখযোগ্য বর্জ্য তৈরি হচ্ছে।
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, যথাযথভাবে নিস্কাশন করা না হলে, কোনো নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এগুলো থেকে মাটি, পানি, বায়ুসহ পরিবেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে ভয়াবহ দূষণ দেখা দেবে। কারণ, এসব বর্জ্য নানাভাবে খাদ্যচক্রে মিশছে। এ বিষয়ে দ্রুত গাইডলাইন তৈরি এবং আক্রান্ত বাসা ও হাসপাতালের বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করতে নতুন পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেন এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার রহমান।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ৯০ শতাংশ মাস্ক সিনথেটিক, যা পলিথিনেরই আরেক রূপ। আর গ্লাভস প্লাস্টিকের। এসব পচতে ৪০০-৫০০ বছর সময় লাগে। প্রতিদিন ঢাকায় উৎপাদিত হয় প্রায় ২০০ টন মেডিকেল বর্জ্য, যার অধিকাংশই গ্লাভস ও মাস্ক। এদিকে, করোনাবর্জ্য সংগ্রহের পদ্ধতিও মেডিকেল ওয়েস্ট রুল ২০০৮ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। করোনাবর্জ্য নানা মাধ্যম হয়ে জলাশয়ে যাচ্ছে। কয়েক মাস আগে আমাদের এক গবেষণায় রাজধানীর লেক ও নদীতে মাছের পেটে সিনথেটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। করোনা সুরক্ষা সামগ্রীর বর্জ্য ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করা না গেলে বড় রকমের ক্ষতি হবে। গুলশানের দু-একটি বাড়িতে করোনা বর্জ্যের জন্য আলাদা ব্যাগ দিয়ে সিটি করপোরেশন দায়িত্ব শেষ করেছে।
জনাব আহমেদ আরো বলেন, বিভিন্ন বাসায় করোনা সুরক্ষা সামগ্রীর বর্জ্য আলাদা রাখার ব্যবস্থা নেই। আলাদা রাখলেও সিটি করপোরেশন সব একসঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বর্জ্যের জন্য আমিনবাজার ও মাতুয়াইলে ডাম্পিং স্টেশন রয়েছে। বাড়ি থেকে আলাদা করে নেওয়া না গেলেও সব বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে আলাদা করা যেতে পারে। সেখানে মেডিকেল বর্জ্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পোড়ানোর ব্যবস্থা করলে ক্ষতি কমবে।
দেশে প্রতিদিন উৎপন্ন মেডিকেল বর্জ্যের পরিমাণের সঠিক হিসাব নেই। তবে মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল ও ৫ হাজার ৫৫টি বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯০৩টি। প্রতিটি শয্যা থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ দশমিক ৬৩ থেকে ১ দশমিক ৯৯ কেজি মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। কোভিড ছড়িয়ে পড়ার পর এটা আরো বাড়তে পারে। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন গবেষণা সূত্র বলছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর মেডিকেল বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায় ৫২ লাখ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের মধ্যে ৪০ লাখই শিশু।
মেডিকেল বর্জ্যসহ আমরা যে প্রতিনিয়ত চা, কফি, জুস, মুদির দোকানের পলিথিন ব্যবহার করছি তা ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। ফলে পরিবেশের তিনটি উপাদান মাটি, পানি, বায়ু দূষিত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের উপর, জলবায়ুর উপর। জলবায়ু পরিবর্তনে জটিল রোগ দেখা যাচ্ছে যেমন- শ্বাসকষ্ট, হার্ট অ্যাটাক, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি। বেড়ে যাচ্ছে অনাকাক্সিক্ষত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। মেডিকেল বর্জ্যসহ প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যবহৃত এসব বর্জ্য ভূমি ক্ষয় করে। জমির উর্বরতা কমে গেলে ভবিষ্যতে দেখা দিতে পারে খাদ্যসঙ্কট। যা আমাদের অর্থনীতে চরম প্রভাব ফেলবে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেঁচে থাকার জন্য জীববৈচিত্র্য রক্ষা প্রয়োজন।
[soliloquy id=”2368″]
মিই/আরা/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ
![Donate](https://statewatch.net/wp-content/uploads/2021/06/xcard.jpg.pagespeed.ic.qcUrAxHADa.jpg)
আপনার মতামত জানানঃ