এক দশকের বেশি সময়ে কাজ এগিয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ। অথচ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল সাড়ে তিন বছরে। বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়ও; শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, যা ১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা বেড়েছে। পুরো কাজ কবে শেষ হবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। জানা গেছে, আগামী বছর বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও অংশ চালুর লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে।
উড়ালসড়কের দুর্গতি
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, উড়ালসড়কটি চালু হলে যানবাহন ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। এ হিসাবে বিমানবন্দর এলাকা থেকে কুতুবখালী যেতে মোটামুটি ২০ মিনিট সময় লাগার কথা। পুরো পথে মোট ১৫টি ওঠার ও ১৬টি নামার জায়গা থাকবে।
এর পাশাপাশি ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এবং কাঁটাবন হয়ে পলাশী মোড় পর্যন্ত উড়ালপথে দুটি সংযোগ সড়কও থাকবে। ফলে সুফল পাবেন ওই এলাকাগামী মানুষেরাও। তবে এই সমস্ত কিছুই খাতা-কলমে আটকে আছে। সুবিধা আর সুযোগের বদলে রাজধানীবাসীর হতাশা আর প্রতিনিয়ত দুর্গতির কারণ এখন এই উড়ালসড়ক।
উড়ালসড়কের শুরু ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ হয়ে এটি যাবে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের মতো। আশা করা হয়েছিল রাজধানীর যানজট কমাতে উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেল সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখব। তবে হয়েছে উল্টো; দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠেছে রাজধানীবাসীর।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) নেওয়া প্রকল্পগুলোর একটি উড়ালসড়ক। এটি বাস্তবায়ন করছে সেতু বিভাগ। ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আরও দুই দফা নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সেতু বিভাগের নথিপত্র অনুযায়ী, ১০ বছরে সার্বিক কাজ মাত্র ২৮ শতাংশ হলেও বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত অগ্রগতি ৬৫ শতাংশের মতো। বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত কাজ চলছে। বাকি অংশে শুরুই হয়নি কাজ।
উড়ালসড়কের কাজ হচ্ছে তিন ভাগে। প্রথম ভাগ বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সাড়ে সাত কিলোমিটার। দ্বিতীয় ভাগ বনানী থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ছয় কিলোমিটারের কিছু কম। তৃতীয় ভাগ মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার পদ্মা সেতুর পরই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিল উড়ালসড়ক প্রকল্পে। এর কারণ ছিল ঢাকায় তখন প্রস্তাবিত অন্য প্রকল্পের কারণে যে চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তা থেকে ঢাকাবাসীকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া। তিনি বলেন, সময়ক্ষেপণের কারণে আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। উল্টো ব্যয় বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কতটা উপকার হবে, এখন সেই প্রশ্নই দেখা দিয়েছে।
প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি
উড়ালসড়ক প্রকল্পের দুটি ভাগ। মূল কাঠামো নির্মাণ এবং সহযোগী প্রকল্প। চুক্তি অনুযায়ী, মূল কাঠামো নির্মাণ ব্যয়ের ২৭ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করবে সরকার। বাকি ৭৩ শতাংশ বিনিয়োগ করবে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। এ কাজে শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে তা ২৩৭ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ধরা হয়।
সহযোগী প্রকল্পের পুরো ব্যয় সরকারের। জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন সরানো ও পরামর্শকদের ব্যয় মেটানোর জন্য এ প্রকল্প নেওয়া হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। পরে তা ১ হাজার ৭০১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ব্যয় এতটা বেড়ে যাওয়ার কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাড়তি সময় লাগা। সহযোগী প্রকল্পের ব্যয় যেহেতু পুরোটা সরকার বহন করছে, তাই এ খাতে ১ হাজার ৭০১ কোটি বাড়তি খরচের টাকা সরকারি কোষাগার থেকেই দিতে হবে। সব মিলিয়ে প্রকল্পটির সর্বশেষ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, যা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ সূত্র।
এদিকে উড়ালসড়ক প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার বলেন, আগামী বছর জুনের মধ্যে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত চালুর একটি লক্ষ্য রয়েছে। বাকিটা পরে হবে। তিনি বলেন, এখন কাজের গতি ভালো। টাকার সমস্যাও কেটেছে। করোনার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে।
নির্মাণকাজে বিলম্বের কারণ
থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ইতাল–থাই) উড়ালসড়ক নির্মাণের কাজ করছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠানটিকে কাজের দায়িত্ব দেয় সরকার। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ২০১১ সালের শুরুতে চুক্তি করার পরও নকশা বদল ও জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় দুই বছরের মতো দেরি হয়। পরে ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে ইতাল–থাইয়ের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে সেতু বিভাগ।
২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর এবং ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট দুই দফা নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু কাজ চলে ঢিমেতালে।
উড়ালসড়ক প্রকল্পে দেরি হওয়ার জন্য বড় দায় ইতাল–থাইয়ের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ইতাল–থাইকে কাজ দেওয়া হয়েছিল নিজের টাকা বিনিয়োগ করার শর্তে। কিন্তু নির্মাণকাজের টাকা জোগাড় করতেই কোম্পানিটি লাগিয়ে দেয় ৯ বছর।
এদিকে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে অন্য একটি বিষয়। ইতাল-থাইয়ের সঙ্গে চুক্তির এক জায়গায় বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারী যে বিদেশি ঋণ নেবে, এর সুদের জন্য কর দিতে হবে না। শর্তে না থাকলেও এর সঙ্গে বাড়তি হিসেবে প্রকল্পে ব্যবহৃত পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় কেনার দাবি করেছে ইতাল–থাই।
সূত্র মতে, গত বছরের ২৯ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়ে দিয়েছে, কর ও শুল্ক সুবিধার কোনোটাই দেওয়া সম্ভব নয়। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে ইতাল–থাই আবার কর ছাড়ের আবেদন করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এই বিষয়ে এখনো দেনদরবার চলছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ