বাংলাদেশের তাঁতীদের তৈরি লুঙ্গি। স্থানীয় বাজার থেকে তা পাইকারি দামে সংগ্রহ করছেন ভারতীয় ব্যবসায়ী বা তাদের এজেন্টরা। এভাবে প্রতিবছর প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা মূল্যের অন্তত ৮৫ লাখ পিস লুঙ্গি যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। কিন্তু ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এসব লুঙ্গি বাংলাদেশি লুঙ্গি হিসেবে বিক্রি করছেন না। বাংলাদেশ থেকে নেয়া লুঙ্গিগুলোতে ভারতের বিভিন্ন বস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের স্টিকার লাগিয়ে সেগুলো বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশি লুঙ্গির মান বিশ্বে প্রশংসিত হওয়ায় এসব লুঙ্গিকে নিজেদের দাবি করে তারা ভারতীয় লুঙ্গির বাজার তৈরি করছে। তাছাড়া চড়া দামে এসব লুঙ্গি রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছে ভারত।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের লুঙ্গির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববাজারে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ২০টি দেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি পিস লুঙ্গি বৈধভাবে রফতানি হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কাপড় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশি লুঙ্গির এই বাজার দখলের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বৈধ-অবৈধ সব উপায়ই অবলম্বন করছে তারা। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ সতর্কতা ও নজরদারি প্রয়োজন হলেও সেরকম কোনো উদ্যোগ নেই বিধায় হতাশায় ভুগছেন দেশীয় লুঙ্গি উৎপাদকরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের লুঙ্গি ভারতে রফতানি শুরু হয়। তখন প্রতি মাসে চার ট্রাক লুঙ্গি (৬০ হাজার পিস) রফতানি হতো। পর্যায়ক্রমে চাহিদা ও রফতানির পরিমান বাড়তে থাকে। গড়ে প্রতি সপ্তাহে (৭ ট্রাক) এক লাখ পাঁচ হাজার পিস, সেই হিসেবে বছরে (৩৬৪ ট্রাক) ৫৪ লাখ ৬০ হাজার পিস লুঙ্গি ভারতে যাচ্ছে।
বেড়ার পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ি শহিদ আলী জানিয়েছেন, ভারতের শতাধিক ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর হাট ও টাংগাইলের করটিয়াহাট থেকে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ পিস লুঙ্গি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। পরে তারা সেই লুঙ্গি উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিন ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান, নদিয়া, মূর্শীদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিন দিনাজপুর, কোচবিহার, হাওড়া ও হুগলীর নামিদামি শপিংমল, বিপনী বিতান ও ছোট বড় পাইকার এবং রফতানিকারকদের কাছে বিক্রি করছেন।
ভারতের মালদহ জেলার আমদানি ও রফতানিকারক এম.এম ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী অজিত দত্ত জানিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ১২ জন আমদানি রফতানি কারক বাংলাদেশের আতাইকুলা, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, করোটিয়া ও বাবুরহাট থেকে লুঙ্গি কিনে সড়ক পথে ট্রাকে করে ভারতের পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও দিল্লিতে নিয়ে মজুদ করে থাকেন। বাংলাদেশি লুঙ্গির স্টিকার পরিবর্তনের বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন এবং বলেন যে, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, লেবানন, ওমান, বাহারাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে এসব লুঙ্গি রফতানি করা হয়।
পাবনা বেসিক সেন্টার সূত্রে জানা যায়, দেশে ১৯৯৮ সালে বিদ্যুৎ চালিত পাওয়ারলুমে লুঙ্গি তৈরি শুরু হয়। বর্তমানে এ ধরনের তাঁতে ৯০ ভাগই লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। এছাড়াও চিত্তরঞ্জ ও পিটলুমে লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। আর উৎপাদিত লুঙ্গির বেশির ভাগই বিদেশে রফতানি হচ্ছে। শাহজাদপুর হাটের পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, টাংগাইলের করটিয়াহাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২৫ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
ভারতের কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ি গোপাল চন্দ্র সেন জানান, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ উৎপাদিত লুঙ্গি ভারতের রফতানিকারকদের প্রতিনিধিরা কিনে নিচ্ছে। ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের কাপড়ের দাম তুলনামূলক অনেক কম, টেকসই এবং উন্নত মানের হওয়ায় তারা এখান থেকে কাপড় কিনছেন।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনা তাঁতি সমবায় সমিতি সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলার হাতিগাড়া, বনগ্রাম, সান্যালপাড়া,সুজানগর, ঈশ্বরদী, সিরাজগঞ্জের পুকুরপাড়, নগরডালা, ডায়া, নরসিংদী জেলার চরসুবুদ্ধি, হাইরমারা, নিলক্ষা, ঘোড়াশাল, টাংগাইল জেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলসুধা, বল্লা, রামপুরসহ আশেপাশের কয়েকটি জেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম তাঁত প্রধান এলাকা। এখানকার তাঁতে তৈরি লুঙ্গির সুনাম ও কদর এখন দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
পাবনা জেলা কেন্দ্রীয় শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান আলী আশরাফি বলেছেন, কয়েক বছর ধরে সুতার অস্থিতিশীল বাজার, রং, কেমিক্যালসহ অন্যান্য উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারনে লুঙ্গি তৈরির খরচ বেড়েছে। কিন্তু নানা প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যে কয়েক বছর ধরে লুঙ্গি খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশি লুঙ্গি রফতানি করে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। এখানে সরকারি হস্তক্ষেপ দরকার। আমরা সরকারি সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লুঙ্গি রফতানি করে বিশ্ব বাজারে জায়গা করে নেয়ার পাশাপাশি বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে।
মিই/আরা/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ