করোনাভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পাল্টে যাচ্ছে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার থাকা ও না থাকা দেশগুলোর বিভাজন আরও গভীর হচ্ছে। বিশেষ করে অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ধনী দেশগুলো নিজেদের কাছে থাকা টিকা আরও আঁকড়ে ধরছে। এমন সময় তারা এই পদক্ষেপ নিচ্ছে যখন টিকার অভাবে বিশ্বের অনেক স্থানে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
নতুন করে সংক্রমণ বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বুস্টার ডোজের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণির মানুষকে বুস্টার ডোজ দিয়ে সুরক্ষিত রাখার উদ্যোগ নেওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অনেক দেশ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইসরায়েলের মতো আরও কিছু ধনী দেশ তাদের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশকেই টিকা দেওয়ার পর এখন বুস্টার অর্থাৎ টিকার তৃতীয় ডোজ দেওয়া শুরু করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ধনী দেশগুলো যদি অন্তত সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত তাদের নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দেওয়া বন্ধ করে তাহলে ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে টিকা পাওয়া নিয়ে যে মারাত্মক বৈষম্য তৈরি হয়েছে তা কিছুটা হলেও দূর করতে সহায়ক হবে।
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত ও ধনী রাষ্ট্র বলে পরিচিত দেশগুলো অবশ্য জাতিসংঘের স্বাস্থ্য বিষয়ক অঙ্গসংস্থাটির এমন আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বুস্টার ডোজ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউএইচও’র এমন আহ্বানকে ‘ভুল পছন্দ’ বলে বর্ণনা করেছে।
তবে ধনী দেশগুলোর এই গোয়ার্তুমির কারণে টিকা নিয়ে বিশ্বে বিশৃঙ্খলা বাঁধবে এবং একইসাথে বিশ্বে করোনায় মৃত্যু আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পশ্চিমা বিশ্ব যদি কোভিড টিকা অন্য দেশগুলোকে দেওয়ার পরিবর্তে তাদের নিজ নিজ দেশের মানুষদের জন্য বুস্টার ডোজকেই অগ্রাধিকার দিয়ে ‘বাকি বিশ্বের প্রতি তাদের দায়িত্ব অগ্রাহ্য করে’ তাহলে বিশ্বজুড়ে আরও অনেক মানুষের মৃত্যু হবে করোনায়। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে লেখা নিবন্ধে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রধান অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড এবং বৈশ্বিক টিকা জোট গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমুনাইজেশন বা গ্যাভির প্রধান নির্বাহী সেথ বার্কলি এভাবেই সতর্ক করেছেন।
তারা বলছেন যে, মহামারির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বজুড়ে কোভিড টিকাদান কর্মসূচির জন্য বৈজ্ঞানিক ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি দেখা দিতে পারে।
তারা লিখেছেন, ‘নীতি নির্ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ধনী দেশে যখন বড় পরিসরে বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে, তখন বাকি বিশ্বজুড়ে এই বার্তা চলে যাবে যে তাহলে বিশ্বের সর্বত্র হয়তো টিকার বুস্টার ডোজ প্রয়োজন। এতে করে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির বাইরে অনেক টিকার ডোজ প্রয়োজন পড়বে। ফলে যেটা হবে, যারা এখনো টিকার এক ডোজ পাননি তাদের মধ্যে অনেকে মারা যাবেন; যা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনার লাগাম টানার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।’
‘যদি বৈজ্ঞানিক ভিত্তির কথা চিন্তা না করে লাখ লাখ মানুষকে এভাবে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়, তাহলে ইতিহাস আমাদের এই সময়কে এভাবে স্মরণ করবে, যখন রাজনৈতিক নেতারা বড় সংকটে বাকি বিশ্বের প্রতি তাদের দায়িত্ব অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইসরায়েলের মতো আরও কিছু ধনী দেশ তাদের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশকেই টিকা দেওয়ার পর এখন বুস্টার অর্থাৎ টিকার তৃতীয় ডোজ দেওয়া শুরুর করার মধ্যে টিকা বিশেষজ্ঞরা এমন সতর্কবার্তা উচ্চারণ করলেন।
অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড ও গ্যাভির সেথ বার্কলি বলছেন, ‘চলতি বছরে করোনায় যেসব মানুষের মৃত্যু হবে আমরা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম তাহলে তাদের অধিকাংশের মৃত্যু ঠেকানো যেত। সবার স্বার্থেই ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের টিকা দিতে হবে।’
ধনী দেশে যখন বড় পরিসরে বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে, তখন বাকি বিশ্বজুড়ে এই বার্তা চলে যাবে যে তাহলে বিশ্বের সর্বত্র হয়তো টিকার বুস্টার ডোজ প্রয়োজন। এতে করে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির বাইরে অনেক টিকার ডোজ প্রয়োজন পড়বে। ফলে যেটা হবে, যারা এখনো টিকার এক ডোজ পাননি তাদের মধ্যে অনেকে মারা যাবেন; যা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনার লাগাম টানার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
‘এতে করে বিশ্বে প্রকোপ ছড়ানো করোনার নতুন ধরনের ঝুঁকি হ্রাস পাবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ কমবে। উন্মুক্তভাবে ভ্রমণ, বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত এবং এই ধরনের নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রাজনীতিবিদদের আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব বাড়াবে।’
এদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে লাখো মানুষ করোনাভাইরাসের টিকার অপেক্ষায় আছেন। আর এসব দেশে ব্যাপক অর্থে হার্ড ইমিউনিটি এখনও কল্পনাতীত। টিকাদানের হার মন্থর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়। মহামারিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশগুলো এখন এই দুটি এলাকায়। কর্তৃপক্ষ পড়েছেন দ্বিমুখী সংকটে। টিকাদান ছাড়া কীভাবে মৃত্যু কমানো যাবে এবং মানুষকে আর ঘরে রাখা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবিক ত্রাণ সংস্থা, সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ সবাই সতর্ক করে বলছেন, আরও বেশি তথ্য পাওয়ার আগে বুস্টার ডোজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে। বরং উদ্ধৃত টিকাগুলো যেখানে সংক্রমণ বেশি সেখানে দান করার জন্য। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিয়েছে। কর্মকর্তারা মনে প্রাণে সংক্রমণের আরেকটি ঢেউ ও লকডাউন এড়াতে মরিয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মে মাসে বিশ্বের ধনী দেশগুলো প্রতি ১০০ জন মানুষের জন্য প্রায় ৫০ ডোজ টিকা প্রয়োগ করেছে। এরপর এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশগুলো সরবরাহ ঘাটতির কারণে প্রতি ১০০ জনের জন্য মাত্র ১.৫ ডোজ টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে।
ডিউক ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশন সেন্টারের সহকারী পরিচালক অ্যান্ড্রিয়া টেইলর জানান, বৈশ্বিক সংক্রমণ ঠেকাতে বুস্টার ডোজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ফলে উচ্চ আয়ের দেশসহ সবাইকে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলা হবে।
তিনি বলেন, যদি জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ বিশ্বের সবার জন্য দুটি ডোজ নিশ্চিত করার আগে বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আমরা সত্যিকার অর্থে কোনও সমস্যার সমাধান করছি না। এটি বড় একটি ক্ষতে ব্যান্ড অ্যাইড লাগানোর মতো।
টেইলর আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যেমন আমরা দেখেছি যখন অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণ ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে তা ঠেকানোর মতো কিছুই ছিল না। এখন এমন পরিস্থিতি আফ্রিকাতেও। ফলে যখন আরও বিপজ্জনক ও আরও বেশি সংক্রামক ভ্যারিয়েন্ট ছড়াচ্ছে তখন আমরা আরও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে পারি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তি তুলে ধরে বলছে, সবাই নিরাপদ না হলে কেউই সুরক্ষিত নয়। কারণ যতক্ষণ করোনার সংক্রমণ অনিয়ন্ত্রিত থাকবে ততই নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এমনকি টিকা প্রতিরোধী ভ্যারিয়েন্টও দেখা দিতে পারে। যার ফলে বিশ্বের হুমকি আরও দীর্ঘায়িত হবে।
ডিউক গবেষক টেইলর বলেন, মহামারির এই মুহূর্তে ধনী দেশগুলোর টিকাদানের হার উদযাপন করা একেবারে বেমানান। এই মুহূর্তে যদি আফ্রিকা টিকা ভর্তি একটি বিমান পাঠানো হয় সেটিই খবর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৩
আপনার মতামত জানানঃ