করোনা সংক্রমনে পঙ্গু হয়ে যাওয়া বিশ্বকে সুস্থ্য করার একমাত্র মাধ্যম ভ্যাকসিনেশন। তবে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ নিয়েও চলছে নানারকম কারসাজি। এতে করে মহামারী থেকে রক্ষা পাবার পথ আরও বন্ধুর হচ্ছে।
এবার বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ জার্মানির এমন একটি ভয়ংকর ঘটনা সামনে এসেছে যা বেশ উদ্বেগজনক। করোনা মহামারী প্রতিরোধে চলমান টিকাদান কর্মসূচির মধ্যে প্রায় ৮ হাজার ৬০০ জনের শরীরে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের পরিবর্তে স্যালাইন পুশের ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে এবং রেড ক্রসের একজন নার্স এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এখন ওই ৮ হাজার ৬০০ মানুষকে নতুন করে করোনা টিকা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) একটি নির্দেশনা জারি করে। স্থানীয় কাউন্সিলর এসভেন অ্যামব্রোসি ফেসবুকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত বলে জানিয়েছেন।
গা শিউরে ওঠার মতো এই ঘটনাটি ঘটেছে উত্তর জার্মানির নর্থ সি কোস্ট এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল ফ্রাইসল্যান্ডে। গত বসন্তের শুরুতে এই ঘটনা ঘটলেও সম্প্রতি তা সামনে এসেছে। সেসময় ফ্রাইসল্যান্ডের টিকাদান কেন্দ্রে অভিযুক্ত ওই নার্স মানুষের শরীরে আসল করোনা টিকার পরিবর্তে ইনজেকশনের মাধ্যমে স্যালাইন পুশ করেন।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবদেহে স্যালাইন প্রবেশ ক্ষতিকর কিছু নয়। তবে গত মার্চ ও এপ্রিলে যখন স্যালাইন পুশের এই ঘটনা ঘটেছিল তখন ফ্রাইসল্যান্ড এলাকার বেশিরভাগ বয়স্ক ব্যক্তি টিকা নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর তারাই এখন করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে করোনা টিকা না দিয়ে মানবদেহে স্যালাইন পুশের এই ঘটনার পেছনের কারণ এখনও জানা যায়নি। সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ওই নার্সেরও নামও প্রকাশ করেনি পুলিশ। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোপূর্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা টিকার সমালোচনা ও কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ জানিয়ে বেশ কিছু পোস্ট দিয়েছিলেন অভিযুক্ত ওই নার্স।
অবশ্য তদন্ত শুরু হলেও ওই নার্সকে আটক বা ভ্যাকসিন প্রতারণার মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে কি না সেটি এখনও পরিষ্কার নয়। তবে সংবাদ মাধ্যম এনডিআর জানিয়েছে, ভ্যাকসিন প্রতারণা সংক্রান্ত এই মামলাটি স্পেশাল ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা সাধারণত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্ত করে থাকে।
ভারতেও ভুয়া টিকার অভিযোগ
এর আগে জুন মানে ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মুম্বাইয়ে ২ হাজার ও কলকাতায় ৫০০ জনকে করোনার ভুয়া টিকা প্রদান করা হয়েছে। গত এপ্রিল ও মে মাসে ভারতে করোনা মহামারি ভয়াবহ রুপ নেয়। পরে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এরপরই দেশটিতে টিকাদানের হার দ্রুত বেড়েছে।
এসময় প্রায় দুই হাজার মানুষের শরীরে করোনার টিকা বলে স্যালাইন সলিউশন পুশ করা হয়েছে। এই ঘটনায় একটি বেসরকারি হাসপাতালের দুই চিকিৎসকসহ দশ জনকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, জালিয়াত চক্র একটি আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের টার্গেট করে এসব ভুয়া টিকা দিয়েছে।
মুম্বাই পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার বিশ্বজিত পাতিল বলেন, ‘পরে আমরা জানতে পারি এই চক্রটি আরও আটটি ক্যাম্প আয়োজনের চেষ্টা করছিলো।’ এ ছাড়া অভিযুক্তদের কাছ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া ১২ লাখ ৪০ হাজার রুপিও উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে কলকাতা পুলিশ জানায়, অন্তত আটটি টিকাদানের ভুয়া ক্যাম্প চালানোর অভিযোগে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। সরকারি চাকুরিজীবী পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তি এসব ক্যাম্প পরিচালনা করেছে। একটি ক্যাম্প থেকে অন্তত ২৫০ জন শারিরীক প্রতিবন্ধী এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ টিকা নিয়েছে। এ ছাড়া শহরের মোট ৫০০ জনকে এসব ভুয়া টিকা দেওয়া হয়েছে।
কলকাতা পুলিশের কর্মকর্তা অতিন ঘোষ জানিয়েছেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকা কোভিশিল্ডের ভুয়া লেবেল লাগানো ডোজ উদ্ধার করেছেন তারা। টালিউড অভিনেত্রী ও রাজনীতিবিদ মিমি চক্রবর্তী একটি কেন্দ্রে টিকা নেওয়ার পর সন্দেহ পোষণ করে পুলিশকে জানালে এই জালিয়াতির ঘটনা সামনে আসে। সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছ থেকে ভারত সরকারের ভুয়া পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
কলকাতার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দেবাশীষ বারুই জানায়, ভুয়া টিকা গ্রহণকারী অনেকেই এখন সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে ভয়ে আছেন। তিনি বলেন, ‘জরুরি পরিস্থিতির উদ্ভব হলে যে এলাকায় ভুয়া টিকা দেওয়া হয়েছে সেই এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্প আয়োজন করা হবে।‘
বাংলাদেশে সুই পুশ করে টিকা না দিয়েই সিরিঞ্জ ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটে
এমনকি বাংলাদেশেও ঘটেছে টিকা নিয়ে একটি নেতিবাচক ঘটনা। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে করোনার টিকা গ্রহণকারীদের শরীরে সুচ ঢোকালেও টিকা পুশ না করেই সিরিঞ্জ ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ডেপুটি সিভিল সার্জন শামীম হুসাইন চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন সিভিল সার্জন। কমিটি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দিলে এ ঘটনায় জড়িত উপজেলা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক সাজেদা আফরিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বুথে সাজেদা টিকা দিচ্ছিলেন। এ সময় তিনি গ্রহণকারীদের শরীরে সুচ ঢুকিয়ে টিকা পুশ না করেই তাড়াহুড়া করে সিরিঞ্জ ঝুড়িতে ফেলে দিচ্ছিলেন। বিষয়টি টিকা নিতে আসা কয়েকজনের নজরে পড়লে তারা আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শামীম হোসেনকে বিষয়টি জানান। ঝুড়িতে থাকা পরিত্যক্ত সিরিঞ্জগুলোর ২০টির ভেতর টিকা দেখতে পান আরএমও। তিনি বিষয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে জানান। তদন্ত কমিটির প্রধান শামীম হুসাইন জানান, তারা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন।
টিকা নিয়ে এমন নেতিবাচক কাজকর্ম বেশ উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন নজির সামনে এলে সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাবে টিকা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর থেকে, যা করোনা সংক্রমণ বাড়াতে আগুনের ঘি এর মত কাজ করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৮১২
আপনার মতামত জানানঃ