আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি একটি অন্যতম ভোগান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো বিশ্বের কাছেই। কোথাও অতিবৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে বীজতলা। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে পানি নিষ্কাশনের জন্য লিখিত দিলেও তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই কর্তৃপক্ষের। কৃষকেরা বিপুল ক্ষতির আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।
অন্যদিকে ভরা মৌসুমেও কিছু এলাকায় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এতে করে সময় পার হয়ে গেলে পাটে জাগ দেয়া যাচ্ছে না। পাট চাষের পানি নেই। খালে বিলে পানি না থাকায় মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। তারাও ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে বিপাকে। দ্রুত পানি না পেলে ক্ষতির পরিমান আরও বৃদ্ধি পাবে।
টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে আমনের বীজতলা
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধের ভেতরের ফতেপুর এলাকায়
টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে আমনের বীজতলা। সেখানকার মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প এলাকায় রোপা আমন ধানের ১০০ হেক্টর জমির বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বেড়িবাঁধের ভেতরের এলাকায় এই পানি জমে। পানিনিষ্কাশন না হওয়ায় এসব আমনের চারা এখন নষ্ট হওয়ার পথে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধের ভেতরে চলতি মৌসুমে (গত জুলাই থেকে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত) ৭ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সে লক্ষ্যে গত জুলাইয়ে ৩৮৫ হেক্টর জমির আমনের বীজতলা তৈরি করেন স্থানীয় কৃষকেরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন বলেন, বেড়িবাঁধটির ভেতরে এ পর্যন্ত কৃষকেরা ১০৫ হেক্টর জমির বীজতলায় চারা রোপণ করেছেন। এর মধ্যে ১০০ হেক্টর জমির বীজতলাই তলিয়ে আছে। তিনি অভিযোগ করেন, ওই পানিনিষ্কাশনে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবু পানি সরানোর উদ্যোগ নেই। এতে চলতি মৌসুমে আমন চারার সংকট দেখা দেবে। তাঁর দেওয়া চিঠির কপি স্থানীয় সাংসদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও (ইউএনও) দেওয়া হয়েছে।
ফতেপুর, সিপাইকান্দি, চরহরিঘোষ, ঠেটালিয়া, লুধুয়া, গজরা, আমুয়াকান্দা, রাঢ়িকান্দি ও ফরাজীকান্দি এলাকায় বীজতলা পানির নিচে। সেখানে গজাচ্ছে শেওলা ও লতাগুল্ম। ফতেপুর এলাকার কৃষক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, এবার তার ৮০-৯০ শতাংশ জমিতে আমনের আবাদ করার ইচ্ছা। এ জন্য দুটি বীজতলা করেছেন। কিন্তু জলাবদ্ধতায় বীজতলার চারায় পচন ধরেছে।
সেচ প্রকল্পটির ফতেপুর, ঠেটালিয়া ও সিপাইকান্দি এলাকার পানি ব্যবহারকারী দলের সাধারণ সম্পাদক গোলাম নবীর অভিযোগ, বেড়িবাঁধটির ভেতরের পানিনিষ্কাশনের খাল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। তারা সেগুলো ভরাট করে বাড়িঘর, স্থাপনা ও ব্যক্তিগত রাস্তা বানিয়েছেন। জমিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার মূল কারণও এটি। বারবার বলা সত্ত্বেও দখলদারদের উচ্ছেদে পাউবোর প্রকৌশলীরা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। তাদের দায়িত্বহীনতার মাশুল দিচ্ছেন কৃষকেরা।
পানির অভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে কৃষক ও জেলে
এখন শ্রাবণ মাসের শেষ পর্যায়। ভরা মৌসুমেও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ৩০টি গ্রামে চলছে পানির হাহাকার। পাটচাষিরা জাগ দিতে পারছেন না। আমন ধান চাষের পানি নেই। খাল-বিলে পানি কম থাকায় মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা।
মির্জাপুর ও বাসাইল উপজেলার সীমান্তবর্তী হাবলা পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম মিয়া বলেন, হাবলা ও গ্রামনাহালী আদাবাড়িতে তার জমি রয়েছে। যেখানে এখনো পানি আসেনি। গত বছর বর্ষা মৌসুমে এই এলাকায় রাস্তার ওপর কোমরপানি হয়েছিল। পানির স্রোতে কদিমধল্যা-বাসাইল সড়কের আদাবাড়ি উত্তরপাড়া এলাকায় প্রায় ৫০ ফুট ভেঙে গিয়েছিল। অথচ এ বছর ঝিনাই নদের পাড় ডুবতে আরও কয়েক ফুট পানি লাগবে। একেক বছর একেক রকম হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) টাঙ্গাইলের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, গ্রামের খেতগুলোতে পানি যাওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকায় নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল রয়েছে। বৃষ্টিও হচ্ছে। উজান থেকে পানিও আসছে। অধিকাংশ নিচু এলাকায় এর মধ্যে পানি ঢুকেছে। ওই সব এলাকায় কী কারণে জমিতে পানি ঢুকছে না, তা বোঝা যাচ্ছে না।
এদিকে নগর ছাওয়ালী গ্রামের বিপ্লব হাওলাদার বলেন, ‘ব্যার (বড়) জাল দিয়্যা মাছ মারি। সেগুলো দিয়্যা চলি। অহন তো চক দিয়্যা পানি নাই। আমাদের খুব অসুবিধা। আমাগো কোনো দিকে কোনো সাহায্যও দেয় নাই। অহন কি কইর্যা চলুম।’
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, মহেড়া ইউনিয়নের গ্রামনাহালী আদাবাড়ি, ভাতকুড়া, ছাওয়ালী, গোড়াকী, ফতেপুর, পাকুল্যা বিল, স্বল্প মহেড়া, বিল মহেড়া, গবড়া, হাবলাসহ ১৫-১৬ গ্রামে পানি নেই। এ ছাড়া ফতেপুর ইউনিয়নের ফতেপুর, হিলড়ার কিছু অংশ, বহনতলী এলাকাতেও পানি আসেনি।
উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন বলেন, জেলেরা সমস্যায় রয়েছেন। কারণ, এ মৌসুমেই তাঁদের সবচেয়ে বেশি আয় হয়। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
আবার চুয়াডাঙ্গাতেও পানির অভাগ পাটে জাগ দিতে পারছে না কৃষকেরা। শ্রাবণ মাসের ২০ দিন হয়ে গেলেও পানি হচ্ছে না সেখানে। খাল-বিলে একটুও পানি নেই যে সেখানে পাট জাগ (পঁচানো) দেবেন। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে জমিতে পাট চাষ করেছিলেন অনেকে। এখন পাট জাগ দেওয়া নিয়ে চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারছেন না তারা। মাঠের পাট নিয়ে এভাবেই দুর্ভোগের কথা জানান ভুক্তভোগী কৃষকেরা।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দীননাথপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, চলতি বছর পাট জাগ নিয়ে বিপদে আছি। এলাকায় আমার মতো বিপাকে পড়েছেন অনেকে। পানির অভাবে তারা সবাই পাট জাগ দিতে পারছেন না। এমন দুর্ভোগে পড়ে অনেকের রাতের ঘুম হারাম হওয়ার অবস্থা। বর্ষার ভরা মৌসুমেও পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি না হওয়ায় জেলার ডোবা-নালা, খাল-বিল ও পুকুরগুলোতে একটুও পানি জমেনি। ফলে পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না কৃষকরা। এদিকে জমি থেকে পাট কেটে নেওয়ার সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে।
পাট চাষে বাম্পার ফলন হয়ে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করলেও এখন পাট কাটার ভরা মৌসুমে পানির অভাবে পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। চলতি মৌসুমে কৃষকরা পাট জাগ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে কেউ কেউ হাঁটুপানিতে পাট জাগ দিয়ে পচানোর চেষ্টা করছেন। এতে পাটের গুণগত মান নষ্ট হওয়াসহ পাটের দাম কম পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জমি থেকে পাট কেটে নেওয়ার সময় পেরিয়ে গেলেও জাগ দেওয়ার পানি না থাকায় কৃষকরা ক্ষেত থেকে পাট কাটছেন না।
চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের তান্নু মন্ডল বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর পাট চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছি। এবার ১৫ বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। বিস্তীর্ণ ক্ষেতের সবুজ পাতা স্বপ্ন দেখাচ্ছিল সোনালি আঁশ ঘরে তোলার কিন্তু তা বিধি বাম। বৃষ্টির দেখা নেই কোথাও। পাট জাগ দিতে পারছি না। ফলন ভালো এবং বাজার দর ভালো থাকলেও সময়মতো পাট জাগ দিতে না পারায় চিন্তায় আছি।
আপনার মতামত জানানঃ