জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নানাভাবেই বিপর্যস্ত করে তুলেছে গোটা বিশ্ব। কোথাও বীভৎস দাবানল কোথাওবা বন্যায় বিপর্যস্ত। তবে খাদ্যসংকট ও বন্যার ভয়াবহতায় বিশ্বের অন্যতম পারমানবিক শক্তিধর দেশ উত্তর কোরিয়া বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে।
উত্তর কোরিয়ায় খাদ্যসংকট
উত্তর কোরিয়া অতীতে অনেক মারাত্মক দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এখন দেশটিতে তীব্র খাদ্যের সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে যাচ্ছে। এক কিলোগ্রাম ভুট্টার দাম হঠাৎ বেড়ে দাঁড়ায় দুই মার্কিন ডলারে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার প্রায় ২ হতে ৩ মাসের সরবরাহের পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘যদি বাণিজ্যিকভাবে আমদানি এবং খাদ্য ত্রাণের মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানো না হয়, তাহলে ২০২১ সালের আগস্ট হতে অক্টোবর পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার পরিবারগুলোকে খুবই কঠিন এক মঙ্গার মুখোমুখি হতে হবে।’
উত্তর কোরিয়ার মানুষ ভুট্টার চেয়ে ভাত বেশি পছন্দ করে, কিন্তু তারপরও তারা ভুট্টা বেশি খায়। কারণ এটি দামে সস্তা। এদিকে চালের দামও বেড়ে গেছে। দেশটিতে চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে চালের দাম বেশ উঠানামা করছে।
গত মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানায়, চলতি বছরে উত্তর কোরিয়ায় ৮ লাখ ৬০ হাজার টন খাদ্যের সংকট রয়েছে। এর জের ধরে দেশটি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
এমনিতেই উত্তর কোরিয়ার মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতি ও খাদ্যসংকট বহুদিন ধরেই ভোগাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। গত বছর অতিমারীর ধাক্কায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। দেশের সীমান্ত বন্ধের নির্দেশ দেন কিম। ফলে চিনের সঙ্গে বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। তারপরই ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার প্রকোপে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে থাকে। গত মাসেই দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের এক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দাবি করেছিল, এবছর ১০ লক্ষ টন খাবারের অভাব দেখা দিতে পারে দেশে। সেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে অবশেষে।
পরমাণু কর্মসূচি ও অস্ত্র তৈরির কারণে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে দেশটির অর্থনীতিও ভেঙে পড়েছে। গত জুনে দেশটি চরম খাদ্যসংকটে পড়েছে বলে শিকার করেন কিম জং উন। তখন তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি ও টাইফুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ জন্য খাদ্যসংকট বেড়ে যায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০২০ সালে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি গত ২৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার এক আইনপ্রণেতা বলেন, জরুরিভাবে খাদ্যসংকট থেকে উত্তরণের জন্য উত্তর কোরিয়ার এখন কমপক্ষে ১০ লাখ টন চাল প্রয়োজন।
দুর্বল অবকাঠামো এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত বেশি প্রকট হয় উত্তর কোরিয়ায়। নির্বিচারে বন উজাড় দেশটিতে বন্যার ঝুঁকি বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বন্যায় হাজারের বেশি ঘর বিধ্বস্ত
ভারী বৃষ্টিতে উত্তর কোরিয়ায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজারের বেশি ঘরবাড়ি, তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে দেশটির পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম কেসিটিভির বরাত দিয়ে আজ রোববার এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
কেসিটিভির ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, বন্যায় বাড়ির ছাদ পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক সেতু। হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। রাস্তাঘাট পানির নিচে। অনেক নদীর বাঁধও ভেঙে গেছে। যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সেবা এখন বিচ্ছিন্ন।
ভয়াবহ এই বন্যার কবলে পড়েছে দেশটির সাউথ হ্যামগিউ প্রদেশ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বন্যাকবলিত মানুষজনকে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ত্রাণ ও অন্যান্য সহায়তা পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন বলে কেসিটিভির ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার আবহাওয়া দফতরের সহকারী প্রধান রি ইয়ং ন্যাম জানিয়েছেন, সবদিকে প্লাবিত হয়ে অবস্থা খারাপ। আবারও বৃষ্টি হলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে। আগামী ১০ আগস্ট পর্যন্ত দেশটির উত্তর উপকূলে আরও বৃষ্টি হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন তিনি।
দরিদ্রকবলিত একনায়কতান্ত্রিক সরকার গত জুনে দেশটিতে চরম খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে বন্যা। দীর্ঘদিন ভঙ্গুর অবস্থায় থাকা কৃষিব্যবস্থা বন্যার কারণে আরও হুমকির মুখে পড়েছে। খাবারের জোগান নিয়ে এখন উদ্বেগ বাড়বে।
দুর্বল অবকাঠামো এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত বেশি প্রকট হয় উত্তর কোরিয়ায়। নির্বিচারে বন উজাড় দেশটিতে বন্যার ঝুঁকি বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাদ্যসংকটে থাকা সত্বেও উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি চলছে
বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করেনি উত্তর কোরিয়া।দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আর করোনা মহামারির কারণে তৈরি হওয়া সংকটের মধ্যে পরমাণু এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া।
আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেও এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারা। শুক্রবার জাতিসংঘের একটি গোপন প্রতিবেদনে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে ওই প্রতিবেদন দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত একটি স্বাধীন কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পিয়ংইয়ং তাদের কর্মসূচির জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি দেশটিতে আর্থিক সংকট চলা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বিকাশ অব্যাহত রেখেছে।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত দেশটি করোনার কারণে বাধ্য হয়ে গত বছর কঠোর লকডাউন দিয়েছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় দেশটির। এমতাবস্থায় গত জুন মাসে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন বলেছিলেন, তার দেশ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন থামানো বা এর গতিকে ধীর করে দেওয়ার জন্য অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসছে নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬)। এই সম্মেলনেও আগের ধারাবাহিকতা চালু থাকবে। আলাদাভাবে প্রতিটি দেশ এমন একটা পথ বের করার ওপর জোর দেবে, যাতে করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিশ্রুতি তারা দিতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৪
আপনার মতামত জানানঃ