করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে প্রতিরোধ করতে দরিদ্র দেশগুলো যখন করোনা টিকার স্বাভাবিক দুই ডোজ পেতেই হিমশিম খাচ্ছে, তখন ধনী দেশগুলো বুস্টার হিসেবে তৃতীয় ডোজ দেয়ার পরিকল্পনা শুরু করেছে। এই পরিকল্পনা স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
এই আহ্বানের কারণ হিসেবে সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস বলেছেন, অনেক উন্নত দেশে সম্প্রতি শুরু হওয়া এই কর্মসূচি স্থগিত করা হলে বিশ্বের সব দেশের অন্তত ১০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
এখন পর্যন্ত বিশ্বের অনেক দেশ করোনা টিকার ডোজ পায়নি উল্লেখ করে গতকাল বুধবার (৪ আগস্ট) এক বার্তায় ডব্লিউএইচও মহাপরিচালক বলেন, ‘ডেল্টা ধরন থেকে নিজেদের জনগণকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন দেশের সরকারের যে উদ্বেগ, তা আমি বুঝতে পারি; কিন্তু বিশ্বের যেসব দেশ করোনা টিকার মোট উৎপাদিত ডোজের সিংহভাগ ইতোমধ্যে কিনে ফেলেছে, তারা এই বুস্টার ডোজের জন্য আরও বেশি টিকা কেনা শুরু করবে- এটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটার পরিসংখ্যান অনুসারে, এ পর্যন্ত আফ্রিকার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ করে করোনা টিকা পেয়েছেন। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ধনী অঞ্চলে এর হার প্রায় ৫০ শতাংশ।
এছাড়া বিশ্বব্যাংকের সূচকে উচ্চআয়ের দেশগুলোতে প্রতি ১০০ জন মানুষ টিকা পেয়েছেন প্রায় ১০১ ডোজ করে। চলতি সপ্তাহেই তারা ১০০ ডোজের মাইলফলক পার হয়েছে। সেই তুলনায় তালিকার তলানিতে থাকা নিম্নআয়ের ২৯টি দেশে এখনো এর হার পড়ে রয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশে।
বিশ্বের অনুন্নত ও দরিদ্র দেশসমূহের চিত্র অবশ্য একেবারেই বিপরীত। ডব্লিউএইচওর কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে গড়ে করোনা টিকার ডোজ নিয়েছেন মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। হাইতি, ডিআর কঙ্গোসহ অনেক দেশের কোনো মানুষ এখন পর্যন্ত টিকার ডোজ নিতে পারেননি।
ডেল্টার প্রকোপে ইতোমধ্যে করোনার এশীয় উপকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ইন্দোনেশিয়ার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ দশমিক ৯ শতাংশ টিকার ডোজ সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজগ নিজেই তৃতীয় ডোজ টিকা নিয়ে ষাটোর্ধ্বদের জন্য বুস্টার ডোজ কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন। জার্মানির সরকার মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) ঘোষণা দিয়েছে, দেশের নাগরিকদের তৃতীয় ডোজ হিসেবে মডার্না এবং ফাইজার টিকার ডোজ দেওয়া হবে। যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে জানিয়েছে, দেশের বয়স্ক ও সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা লাখ লাখ মানুষকে সেপ্টেম্বর থেকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে পর্যাপ্ত পরিমান টিকার ডোজ মজুত আছে এবং নাগরিকদের সুরক্ষায় বুস্টার ডোজ দেওয়া যে কোনো সময় শুরু হতে পারে। এছাড়া, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অনেক দেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের টিকাদান কর্মসূচিও শুরু হয়েছে। যেখানে বিশ্বের অনুন্নত ও দরিদ্র দেশসমূহের চিত্র অবশ্য একেবারেই বিপরীত।
এছাড়া, টিকার ডোজ কিনতে না পারার কারণে এখন পর্যন্ত গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি, বা শুরু করলেও স্থগিতে বাধ্য হয়েছে- এমন দেশের সংখ্যা বিশ্বে কম নয় বলে এর আগে একাধিকবার জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
টিকার বণ্টনে সমতা আনতে দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশসমূহকে টিকার ডোজ সরবরাহে এর আগে উন্নত বিশ্বকে বেশ কয়েকবার আহ্বান জানিয়েছেন গেব্রিয়েসুস। গত মে মাসে বিভিন্ন দেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের টিকার আওতায় আনার বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি।
এ অবস্থায় ডব্লিউএইচও প্রধানের এই বক্তব্য দরিদ্র দেশগুলোকে আশা দেখালেও তাতে খুব একটা সাড়া দেয়ার লক্ষণ নেই পশ্চিমা বিশ্বের। যুক্তরাষ্ট্র তো ইতোমধ্যে গ্যাব্রিয়েসুসের প্রস্তাব নাকোচ করে দিয়েছে। বুধবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি এটিকে ‘ভুল বিকল্প’ উল্লেখ করে দাবি করেছেন, একসঙ্গে দুটি কাজই করা সম্ভব। অর্থাৎ নিজেরা বুস্টার ডোজ নেয়ার পাশাপাশি অন্য দেশগুলোতে টিকাদানও অব্যাহত রাখা যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ১১ কোটির বেশি ডোজ বিতরণ করেছে উল্লেখ করে এ মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, অন্য দেশগুলো মিলে যা দিয়েছে এটি তার চেয়েও বেশি। প্রত্যেক মার্কিনির টিকা নিশ্চিতের জন্য আমাদের কাছে যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে। এফডিএ যদি সিদ্ধান্ত নেয়, জনগণের একাংশের জন্য বুস্টার ডোজ লাগবে, তাহলে তার জন্যেও আমাদের যথেষ্ট টিকা থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৪১৬
আপনার মতামত জানানঃ