জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। এর মধ্যে বন্যা, তাপদাহের মত বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো জেলায় বজ্রপাতে মৃত্যু হওয়ার খবর আসছে সংবাদ মাধ্যমে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে আজ বুধবার (৪ আগস্ট) বউভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাঁকা গ্রামে নদীর ধারে এ ঘটনা ঘটে।
এখন অব্দি ১৬ জন নিহতে নাম জানা গেছে। এনারা হলেন- জমিলা (৫৮), তবজুল (৭০), আদল (৩৫), রফিকুল (৬০), লেচন (৫০), সজীব (২২), টকি বেগম (৩০), আলম (৪৫), পাতু (৪০), সহবুল (৩০), বেলি বেগম (৩২), বাবলু (২৬), মোছা. মোৗসুমী (২৫), টিপু সুলতান (৪৫), বাবু (২০) ও অসিকুল ইসলাম ডাকু (২৪)।
স্থানীয় বাসিন্দা ও পাঁকা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন মাস্টার এক জাতীয় দৈনিককে জানান, সদর উপজেলার নারায়ণপুর থেকে বউভাতের অনুষ্ঠানে আসার পথে বৃষ্টি শুরু হলে নৌকার সবাই নদীর ধারে একটি অস্থায়ী ছাউনির নিচে আশ্রয় নেন। এ সময় সেখানে হঠাৎ বজ্রপাত শুরু হলে ঘটনাস্থলেই ১৫ থেকে ১৬ জনের মৃত্যু হয়। হাসপাতালে যাওয়ার পথে আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২০ জনের মতো মারা গেছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, মৃতদের মধ্যে ১৯ জন বউভাতের অনুষ্ঠানে যাওয়ার যাত্রী ছিলেন। এছাড়া মৃত আরেকজন দক্ষিণ পাকা গ্রামের নৌকার মাঝি ছিলেন। সব মিলে নৌকায় নারী-শিশু মিলে ৫৫ জন যাত্রী ছিলেন। তারা সবাই বৃষ্টি আসার পর নৌকা থেকে নেমে নদীর ধারে উঠে আসেন।
আহতদের শিবগঞ্জ উপজেলা কমপ্লেক্স ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। মৃতদের পরিচয় জানতে সুর্যনারায়ণপুরে পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রাকিবসহ পুলিশের একটি দল গেছেন বলে জানান শিবগঞ্জ থানার ওসি ফরিদ হোসেন। স্থানীয়রা ২০ জন বললেও শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব-আল-রাব্বী বিকেল ৪টায় জানান মৃতের সংখ্যা ১৭ জন।
এ বিষয়ে শিবগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ উদ্দিন জানান, নৌকাটি দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের ঘাটে এসে পৌঁছার পরপরই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, হাসপাতালে আহতদের আনা হচ্ছে। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে গুরুতর আহত এক শিশুকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। শুনেছি শিশুটির বাবা-মা মারা গেছেন। সবার নাম ও ঠিকানা সংগ্রহে পুলিশ কাজ করছে।
ফায়ার সার্ভিস চাঁপাইনবাবগঞ্জ স্টেশনের উপপরিচালক সাবের আলী জানান, মৃত ও আহতদের নৌকায় করে সদর উপজেলার আলিমনগরের ঘাটে নিয়ে আসলে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. কামরুন নাহার নাসু ঐ জাতীয় দৈনিককে বলেন, বিকেল ৩টা পর্যন্ত হাসপাতালে মৃত ১২ জনকে আনা হয়। এছাড়াও আহত অবস্থায় আরও ৯ জনকে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে এক শিশুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়।
এ বছর বজ্রপাতে মোট প্রানহানি হয়েছে ২৭২ জনের
বিশ্বের বেশি বজ্রপাত সংঘটিত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে সবার উপরে রয়েছে আফ্রিকার কঙ্গো ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। এ তালিকায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বাংলাদেশর নামও রয়েছে।
ডিজাস্টার ফোরামের গবেষণা সহযোগী রাফায়াত ইসলাম ঐ জাতীয় দৈনিককে জানান, ২০২১ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মোট ২৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৫৪ জন, নারী ৩৯ এবং পুরুষ ১৭৯ জন।
বজ্রপাতে এ বছর সবচেয়ে বেশি মারা গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় (৩২ জন)। এছাড়া সিরাজগঞ্জ জেলায় ১৯ জন এবং জামালপুরে ১৬, নেত্রোকোনা ১৫, চট্টগ্রামে ১২ এবং কিশোরগঞ্জ ১০ জন মারা গেছে। সবশেষ আজ (০৪ আগস্ট) চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় বজ্রপাতে ১৭ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন পুরুষ, ৫ জন নারী।
দেশের ২০১১ সালের পর থেকে বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রবণতা ক্রমাগতভাবেই বেড়ে চলছে। ২০১৫ সালে ৯৯ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১, ২০১৭ সালে ২৬২, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন। এছাড়া ২০২০ সালে বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৮০ জন। এর মধ্যে শিশু ৮০, নারী ২৯, এবং পুরুষ ২৭১ জন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরামসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, গত এক দশকে (২০১০ সাল থেকে) দুই হাজারের বেশি মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন কয়েক হাজার নারী-পুরুষ। এর মধ্যে বেশিরভাগই মাঠে কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন।
বজ্রপাত নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের দেওয়া দিকনির্দেশনা-
বজ্রপাত সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময় ঘরে বা বাসাবাড়িতে অবস্থান করতে হবে। ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাইরে না যাওয়া ভালো। তবে অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হওয়া যাবে। বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ অথবা উঁচু স্থানে থাকা উচিৎ না। এ সময়ে ধান ক্ষেতে বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকতে হবে। বজ্রপাতের আশঙ্কা হলে যত দ্রুত গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা বা জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে।
বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতর অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না, সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দার থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা উচিৎ না। প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেককে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যেতে হবে। বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মতো করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ