সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাকে কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদে সহিংস বিক্ষোভে উত্তাল দক্ষিণ আফ্রিকা। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে সংঘাতে। সরকারি হিসাবে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা অন্তত ৩৩৭ জন। ৬ কোটি মানুষের দেশে এমন মৃত্যুর সংখ্যাটি বড়। ১৯৯৪ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বাধীন এএনসি ক্ষমতায় আসে, বর্ণবৈষম্য শেষ হয়। এরপরে গত ২৭ বছরে এত বড় গন্ডগোল কখনো হয়নি।
সংঘাত চলাকালীনই কোয়াজুলু-নাটালের প্রাদেশিক সরকার একটা খসড়া হিসাব দিয়েছিল। এতে দেখা যায়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন র্যান্ড বা ৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এই দাঙ্গায় ধ্বংস করা হয়েছে, প্রায় সাড়ে তিন লাখ টন আখ, যা বিদেশি মুদ্রা আয়ের বড় অবলম্বন। প্রায় ২০০ বিপণিবিতান তছনছ করা হয়েছে। দেশের বৃহৎ খুচরা বিপণিবিতান ‘ম্যাক্র’র কতগুলো শাখা বা গাড়ি-বাড়ি পোড়ানো হয়েছে, সরকার এখনো তার হিসাব করছে। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামিয়ে অবস্থা সামাল দেয় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সরকার।
বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা না করার অপরাধে গত ২৯ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাকে ১৫ মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। জুমা প্রথমে আত্মসমর্পণ করেননি, বরং দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী জুলুদের শীর্ষ নেতা হিসেবে তিনি তাঁর গোষ্ঠীকে উসকানি দেন। অবশেষে ৭ জুলাই তিনি আত্মসমর্পণ করেন, আর অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামে তার সমর্থকেরা।
দ্য ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণার কারণেই রামাফোসাকে সরাতে এত বড় মাপের দাঙ্গা করানো হয়েছে। এএনসি আজ বিভক্ত। একদিকে জুমা, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। সাবেক প্রেসিডেন্ট জুমার দুর্নীতির শেষ দেখতে চান রামাফোসা। যদিও তারা দুজনে এখনো এএনসিতেই আছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে অসংখ্য গোষ্ঠীভিত্তিক উপদলের জন্ম হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হলেন এএনসি থেকে বহিষ্কৃত ৪০ বছর বয়সী জুলিয়াস মালেমা। দেশের আইনসভায় মালেমার দল ইকোনমিক ফ্রিডম পার্টির দুই ডজনের বেশি প্রতিনিধি রয়েছেন। তিনি জুমা আর রামাফোসা—দুজনেরই বিরোধী, তবে সব থেকে বড় বিরোধী ভারতীয়দের।
মালেমার বক্তব্য, দেশের সর্বনাশ করেছে ভারতীয়রা। কিছুদিন আগে তার একটি বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। মালেমা বলেছিলেন, ‘এখানে ভারতীয়দের একটা চক্র কাজ করছে। আমরা যেখানেই যাব, সেখানেই দেখব এই চক্র সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। দোকানপাট, ব্যবসা ইত্যাদি তো বটেই, দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ সরবরাহ, মাইনিং—সবকিছুই এদের নিয়ন্ত্রণাধীন। এদের সরাতে না পারলে কালো মানুষের মুক্তি নেই।’
এই বক্তব্যকে অনেকে বর্ণবাদী বলে আখ্যায়িত করলেও ভারতীয়দের একাংশ মনে করেন, মালেমা বিশেষ ভুল বলছেন না। রিয়া আলগু নামের এক ব্যবসায়ী বললেন, ভারতীয়দের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় উত্তর প্রদেশের গুপ্তা ভাইদের কথা। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসানের পর ১৯৯৪ সালে যখন নতুন দেশ গঠনের কাজ শুরু হয়, তখন নাটালে এসে ঘাঁটি গাড়েন গুপ্তারা। গুপ্তাদের কর্মকাণ্ড নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রয়েছে এই ব্যবসায়ীর।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো যারা ১০০-১৫০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থেকে কিছু টাকাপয়সা করেছে, গুপ্তারা তাদের মধ্যে পড়েন না। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় সব ব্যবসার মধ্যেই ঢুকে রয়েছেন এরা। খনি থেকে সম্পদ তোলা, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ভারী শিল্প, ইন্টারনেট, প্রচারমাধ্যম—যে ব্যবসার নামই করবেন, দেখবেন তার মধ্যে রয়েছেন গুপ্তারা। এর বাইরেও রয়েছেন আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী।’
২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন জুমা। রিয়ার বক্তব্য, তাকে সম্পূর্ণ পকেটে পুরে ফেলেছিলেন গুপ্তারা। জুমার আটজন স্বীকৃত স্ত্রীর একজনকে এবং বড় ছেলেকে চাকরিও দিয়েছিলেন গুপ্তারা। মন্ত্রী ও আমলাদের রোজগেরে মন্ত্রক পাইয়ে দেওয়া, বদলি থেকে সরকারি চাকরি পাওয়ানো, সরকারি জমি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া, সরকারি অবকাঠামো ব্যবহার করে ব্যবসা করাসহ এমন কোনো দুর্নীতি নেই, যার সঙ্গে গুপ্তাদের সম্পর্ক নেই।
রিয়া আলগুর পর্যবেক্ষণ, কয়েক বছর আগে গুপ্তারা বুঝতে পারেন, জুমার ক্ষমতা কমছে এবং তারা দুবাইয়ে পালান। এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে গুপ্তাদের এখানে ফেরানোর চেষ্টা করছে সরকার। এদের জন্যই ভারতীয়দের বদনাম।
একটি জাতীয় প্রচারমাধ্যমের বার্তা সম্পাদক সালমা প্যাটেল বললেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ১৫ লাখ ভারতীয়ের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ অতি ধনী। অধিকাংশই গরিব, কিন্তু এই বড়লোকদের জন্যই বিপদে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের।
দাঙ্গায় ভারতীয়দের মার খাওয়ার আরও একটা ব্যাখ্যা দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার শীর্ষস্থানীয় সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক রামা নাইডু। তিনি বলেন, বর্ণবৈষম্যের দিনে এখানকার শহর বা আধা-শহরের স্থাপত্য এমন ছিল, যাতে কৃষ্ণাঙ্গ ও গরিব মানুষের পাশে শ্বেতাঙ্গদের থাকতে না হয়। বাদামি চামড়ার ভারতীয়দের কলোনিগুলো তৈরি করা হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মাঝখানে। এটার পরিবর্তন করে সব বর্ণের মানুষের মেলামেশার পরিবেশ এএনসি ২৭ বছরে সৃষ্টি করতে পারেনি। অভুক্ত মানুষেরা যখন তাদের অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন প্রথমেই পেলেন ভারতীয়দের। রাগটা গিয়ে পড়ল তাদের ওপরে।
অধ্যাপক দশরথ চেট্টির কথায়, ‘এটা বেছে বেছে ভারতীয়দের ওপরে আক্রমণ নয়, এটা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ওপরে আক্রমণ। কালো মানুষের ওপরেও ভালো রকম হামলা হয়েছে, হামলা হয়েছে শ্বেতাঙ্গদের ওপরেও।’
আফ্রিকা মহাদেশে বারবারই বড় ধরনের গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এর কেন্দ্রে রয়েছে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা-নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক বৈষম্য, সম্পদের অসম বণ্টন ও সংখ্যালঘু বনাম সংখ্যাগুরু জাতিগোষ্ঠীগুলোর তীব্র সংঘাত। অধ্যাপক নাইডু এবং অধ্যাপক চেট্টি দুজনেই বললেন, বড় সংঘাত এড়াতে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবধান হওয়ার সময় এসেছে।
অধ্যাপক নাইডু আরও বলেন, ‘গত কয়েক বছরে আমরা দেখছিলাম, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত নেতা-নেত্রী, যারা দীর্ঘ সময় ধরে একটা বিশাল গণ–আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা পেছনের সারিতে চলে গেছেন। এই দাঙ্গা আবার তাদের রাস্তায় বার করে এনেছে। আমরা দেখছি, তাদের নেতৃত্বে আবার অর্ধশতক আগের মতোই কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ বা বাদামি চামড়ার মানুষেরা হাত ধরাধরি করে রাস্তায় নামছেন, মানুষকে ভাবতে বলছেন, শান্ত হতে বলছেন।’
তিনি মনে করেন, জুলাই মাসের দাঙ্গার মধ্য দিয়েই তাই হয়তো আরও একবার নতুন এক দক্ষিণ আফ্রিকার জন্ম হচ্ছে। যদিও এমন সংঘাতের পেছনের কারণটি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করলেন কোয়াজুলু-নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিটিক্যাল ফুড স্টাডিজ কেন্দ্রের অধ্যাপক শীতল ভুলা। তিনি বলেন, প্রথমেই বলতে হয় খাদ্যসংকটের কথা। লুটপাট শুরু হওয়ার পরে গরিব মানুষেরা বেরিয়ে এসে প্রথমেই কী সংগ্রহ করেন? খাদ্য ও পানীয়।
কোভিড–১৯–এর কারণে অনেকেই কাজ হারিয়েছিলেন, অর্ধভুক্ত বা অভুক্ত অবস্থায় ছিলেন। এর ওপরে চার সপ্তাহ আগে আবার পুরোপুরি লকডাউন শুরু হওয়ায় তাঁরা সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় তাদের নেতা গ্রেপ্তার হওয়ায় অসহায়তা ক্রোধে পরিণত হয়।
জিনি সহগের মাধ্যমে একটি দেশে সম্পদের অসাম্য ও ধনী-দরিদ্রের ফারাকটা বোঝা যায়। এই সংখ্যার বিচারে বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালে জানিয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে অসম দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বলছে, আফ্রিকা মহাদেশের ৫০ শতাংশ (৬৫ কোটি) বাসিন্দার মোট সম্পদের পরিমাণ ২০১৯ সালে ছিল প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্কটা আফ্রিকার তিনজন সর্বোচ্চ ধনীর সম্পদের থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার কম। এই তিন ব্যক্তির মধ্যে দুজন দক্ষিণ আফ্রিকার শিল্পপতি। এই অসাম্য কমানো না গেলে দেশ বড় বিপদের সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজবিদেরা।
আপনার মতামত জানানঃ