বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর প্রভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ভারতে বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ যুবক। সেই বেকারদের একাংশ হতাশ হয়ে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। উদ্বেগের বিষয় হলো দিন দিন এর সংখ্যা বাড়ছে।
২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতে বেকারত্বের কারণে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ২৪ শতাংশ। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র (এনসিআরবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এনসিআরবির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বেকারত্বের কারণে ভারতে আত্মহত্যা করেন ২ হাজার ২৯৮ জন। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৫১ জনে। মধ্যবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে ২ হাজার ৪০৪ ও ২০১৮ সালে ২ হাজার ৭৪১ জন বেকার আত্মঘাতী হন।
এনসিআরবি জানায়, বেকারত্বের কারণে আত্মহত্যার শীর্ষে রয়েছে কর্ণাটক রাজ্য। দক্ষিণ ভারতের ওই রাজ্যে এক বছরে ৫৫৩ জন আত্মঘাতী হয়েছেন। পরের চারটি স্থানে রয়েছে মহারাষ্ট্র (৪৫২), তামিলনাড়ু (২৫১), ঝাড়খণ্ড (২৩২) ও গুজরাট (২১৯)। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে আত্মঘাতী হয়েছেন ৪০ জন বেকার।
করোনা প্রাদুর্ভাবের আগেই ভারতে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। অতিমারির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলেই আশঙ্কা। গত বছর এনসিআরবি জানিয়েছিল, এক দশকে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন দিনমজুররা।
এবছরের মে মাসে ভারত সরকারের উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই যে সমীক্ষা চালিয়েছিল, তাতে দেখা যায় বেকারের সংখ্যা শতাংশের নিরিখে দুই অংক ছাড়িয়ে গেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই তা ১৯ শতাংশে পৌঁছে যায়।
৬ জুনের সমীক্ষায় দেখা গেছে সব মিলিয়ে গোটা দেশে কাজ হারিয়ে নতুন করে বেকার হয়েছেন ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে অধিকাংশ মানুষই গ্রামের। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ২০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন।
এদিকে সর্বশেষ সমীক্ষা হয় ২৫ জুলাই। ভারতের পরামর্শক সংস্থা সিএমআইইর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৫ জুলাই শেষ হওয়া সপ্তাহে সারা ভারতে বেকারত্বের হার এক ধাক্কায় ৭ দশমিক ১৪ শতাংশে উঠেছে। আগের সপ্তাহেই যা ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ ছিল। গ্রামাঞ্চলে সেই হার ৫ দশমিক ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শহরে তা অপেক্ষাকৃত কম বাড়লেও ছাড়িয়ে গিয়েছে ৮ শতাংশের সীমা। ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
এতে সারা ভারতে বেকারত্বের হার এক ধাক্কায় ৭ দশমিক ১৪ শতাংশে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলে সেই হার ৫ দশমিক ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বস্তুত শহরে বেকারত্বের হার অনেক দিন ধরেই গ্রামাঞ্চল এবং জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি। সম্প্রতি সেই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে দাবি করছিল কেন্দ্র। কিন্তু এ দফার সমীক্ষা প্রতিবেদন নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়াল। সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের উদ্বেগ, এর পরে সত্যিই করোনার তৃতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে আছড়ে পড়লে কর্মসংস্থানে তার কতটা প্রভাব পড়বে!
গত বছর মার্চে করোনার হানার পর থেকেই ভারতে কাজের বাজার বিপর্যস্ত। দীর্ঘ লকডাউনের ধাক্কায় ২০২০ সালের এপ্রিল ও মে মাসে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপর লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা ধীরে ধীরে নামতে থাকে।
কিন্তু মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে সে পরিস্থিতি বদলে যায়। সংক্রমণ রোধ করতে রাজ্যগুলো স্থানীয় লকডাউন এবং বিধিনিষেধের পথে হাঁটায় আবারও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। বাড়তে বাড়তে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে বেকারত্বের হার দুই অঙ্ক পেরিয়ে যায়। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় তা আবারও কমতে থাকে। সংশ্লিষ্ট মহলের ব্যাখ্যা, আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি আসা এবং বর্ষা মৌসুমের ওপর নির্ভর করেই বদলে যায় কাজের বাজারের অবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ায় গত বছর লকডাউনের আগে থেকেই বেকারত্ব বাড়ছিল। ফলে করোনা মোকাবিলায় পুরো দেশ ঘরবন্দী হতেই বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে বেকারত্বের হার কমতে শুরু করে বটে, কিন্তু কর্মসংস্থানের গতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়েই ছিল। কাজকর্ম শুরু হলেও নিয়োগে ধারাবাহিক উন্নতি তেমন একটা চোখে পড়েনি।
মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা না দিলে এবং প্রতিষেধক প্রয়োগের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে শুরুতেই শক্ত হাতে থামানো গেলে ভয় কাটত বলে মনে করছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, উৎপাদন এবং পরিষেবা বৃদ্ধির হাত ধরে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো নিশ্চিত হলে নিয়োগও বাড়ত। কিন্তু সিএমআইই তথ্য বলছে, এপ্রিলে তা তো হয়নি, বরং কর্মী আরও কমেছে। এমনকি কাজ খুঁজতেও বেরিয়েছেন অনেক কম মানুষ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজ্যে রাজ্যে বিধিনিষেধ, লকডাউন জুড়ে দিলে ক্ষয়ক্ষতি দেশজুড়ে পূর্ণাঙ্গ লকডাউনের তুলনায় খুব কম কিছু নয়। এই পরিস্থিতিতে উৎপাদন, খুচরা বিক্রি—সব কমে যাবে তা ধারণাতেই ছিল, কিন্তু তা আর কত দিন, সেটাই প্রশ্ন সব মহলের।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা। তবে লকডাউন উঠে গেলে আবারও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছে ক্রেডিট সুসি। তাতে চলতি অর্থবর্ষে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করছে তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৪
আপনার মতামত জানানঃ