গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে করোনা অতিমারির প্রভাব যোগ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে ব্যাপকভাবে কমে আসার পাশাপাশি পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। চলতি বছর এরই মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে দেশটিকে। ফলে গত জুন মাস শেষে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চার বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কা সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই ২১ হাজার ৩০০ কোটি রুপি ছাপায়। একই দিনে রিজার্ভ থেকে ১০০ কোটি ডলারের একটি সভরেন বন্ডের প্রদেয় অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটিকে। তবে এর পরও দেশটিতে কোনো ধরনের মূল্যস্ফীতি দেখা যায়নি বলে দাবি করছেন দেশটির অর্থ সচিব সাজিথ আত্তিগাল্লে।
তিনি বলেছেন, ডলার সংগ্রহের জন্যই ট্রেজারি বিলের বিপরীতে এ অর্থ ছাপানো হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিল বাবদ দায় বাড়লেও তা মুদ্রাবাজারে সঞ্চালিত হয়নি। ফলে অতিরিক্ত এ মুদ্রা ছাপানোর ধারাবাহিকতায় অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কাও নেই।
কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরই মধ্যে দেশটিতে প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে বর্তমানে মিলারদের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে চালের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার কথা ভাবছে শ্রীলঙ্কার সরকার। একই সঙ্গে বাড়তি দামে চাল বিক্রির অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হতে পারে।
মুদ্রা সংকট শ্রীলঙ্কাকে এখন মারাত্মক এক সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ডলারের অভাবে দেশটিতে ক্রমেই আমদানি সংকুচিত করে আনা হয়েছে। কলম্বোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন আর আমদানিকারকদের জন্য কোনো ডলার ইস্যু করছে না। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ব্যবহার করা হচ্ছে রেশনিংয়ের ভিত্তিতে। একই সঙ্গে দেশটিতে একই সময়ে সমান্তরালে ভিন্ন বিনিময় হারের উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে দেশটিতে এখন ডলারের বিকল্প উৎস হয়ে উঠেছে কালোবাজার।
২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। কিন্তু এরপর থেকেই দেশটির অর্থনীতি নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতির এই সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
২০২০ সালে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি)। বাজেট ঘাটতি বেড়ে জিডিপি ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বড় ধরনের টান পড়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়ে গেছে বিদেশি ঋণ। চরম এই সংকট কাটাতে বিভিন্ন দেশ থেকে ইউএস ডলার ধার করছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বাংলাদেশের কাছ থেকেও এ ধরনের সহায়তা চায় শ্রীলঙ্কা।
গত মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে দেড় বিলিয়ন ডলার নিয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের কাছ থেকে ৪০ কোটি ডলার পাওয়ার আশা করছে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদেশি ঋণ পরিশোধে যাতে খেলাপি না হতে হয়, সে জন্যই অনেকটা মরিয়া হয়ে এ ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে শ্রীলঙ্কা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ফিচ রেটিংয়ের হিসাবমতে, বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য শ্রীলঙ্কা সরকারকে আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে অন্তত ২৯ বিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে হবে।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের শেষের দিকে, সভরেন বন্ডের মাধ্যমে নেওয়া ঋণ শ্রীলঙ্কার মোট বকেয়া বৈদেশিক ঋণের ৫০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাণিজ্যিক ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়া দেশটির সরকার যদি কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোর সমাধান করতে পারতো, তাহলে পরিস্থিতি এমন হতো না।
এর আগে লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনাও ঠিক একই ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। শ্রীলংকার মতো দেশটিও এ সংকট মোকাবেলায় বাজারে অতিরিক্ত মুদ্রা সঞ্চালনের পথ বেছে নিয়েছিল। তবে তাতে হিতে বিপরীতই হয়েছে। আরো ভয়াবহ আকার নিয়েছে বিপর্যয়ের মাত্রা। দেখা দেয় বিনিময় হারের ধস ও ব্যাপক মূল্যস্ফীতি।
শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কার মতো আর্জেন্টিনাও সে সময় রিটেইল খাতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালিয়েছিল। তবে তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি। এছাড়া বারবার মুদ্রা ছাপিয়েও সে সময় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি আর্জেন্টিনা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কায়ও আর্জেন্টিনার বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের। এ উপায়কে তারা অভিহিত করছেন ভুলপথে মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস হিসেবে। এ ধরনের বিপর্যয়কর পদক্ষেপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেন্ট্রাল ব্যাংক অব শ্রীলঙ্কার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে দাবি জানিয়েছেন মুদ্রার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণেরও।
তাদের ভাষ্যমতে, শ্রীলঙ্কার জন্য বর্তমানে পরিস্থিতিকে আরো উদ্বেগজনক করে তুলছে বৈশ্বিক পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এরই মধ্যে দেশটিতে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি এবং ব্যবহারিক ও মূল্যবান ধাতুর মূল্য লাগামহীনভাবে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সেখানকার শিল্প খাত নিয়েও বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতিবিদরা বরাবরই অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানোর বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে, এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যায়। বিনিময় হারকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখা যায় না। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ ও নিত্যপণ্যের মূল্যেও ব্যাপক স্ফীতি দেখা যায়। ফলে পণ্যের রেশনিং, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ঘাটতির মতো সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। অন্যদিকে মুদ্রা ছাপিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের প্রবণতা তৈরি হলে এর ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক বিনিময়ের রিজার্ভেও ঘাটতি দেখা যায়। এমনকি যদি শুধু সরকারি বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্যও মুদ্রা ছাপানো হয়, তাহলেও এ ঘাটতি এড়ানো সম্ভব হয় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ