দেশে জুলাই মাস থেকে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড একেরপর এক ভাঙছেই। তবে এমাসে করোনা মৃত্যুর অধিকাংশই মারা গেছে হয় বাড়িতে নতুবা হাসপাতালে আসার পথে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ৩১ জুলাই পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০ হাজার ৬৮৫ জন। এর মধ্যে বাসায় ও হাসপাতালে আসার পথে মারা গেছেন ৫৮৩ জন। এমন মৃত্যুর প্রায় ৬৫ শতাংশই (৩৭৬ জন) ছিল গত জুলাই মাসে। সর্বশেষ গতকাল রোববারও ১৪ জন করোনা রোগী বাসায় থেকে মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের চেয়ে ১০ গুণ বেশি রোগী বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, এ পর্যন্ত বাড়িতে ৫৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে মারা গেছেন ১০৫ জন।
বাড়িতে থাকার রোগীর চিকিৎসা ও সেবার বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের তেমন কোনো নজরদারি নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরা সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি হয়ে আছে।
মহামারির শুরু দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, করোনায় আক্রান্তদের ৮০ শতাংশের রোগীর লক্ষণ মৃদু বা মাঝারি থাকে। তাদের হাসপাতালে ভর্তির দরকার হয় না। ১৫ শতাংশের উপসর্গ তীব্র হয়, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। বাকি ৫ শতাংশের অবস্থা জটিল হয়। তাদেরও হাসপাতাল সেবার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ করোনায় আক্রান্তদের ২০ শতাংশের হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, এখন হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, ১৫ শতাংশ রোগীর হাসপাতাল সেবার প্রয়োজন হয়। এদের মধ্যে ৩ শতাংশের পরিস্থিতি জটিল হয়। এদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সহায়তার দরকার।
অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শনাক্ত হওয়া রোগীর ১০ শতাংশ এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে। অর্থাৎ প্রয়োজন থাকলেও বাকি ৫ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে না বা হতে পারছে না।
কিন্তু এর বাইরেও করোনার উপসর্গ নিয়ে অনেকে বাসায় থাকছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন। জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, গন্ধ চলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা না করিয়ে করোনার সংক্রমণ হয়েছে বলে ধরে নেন কেউ কেউ। ফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাসাতেই থাকেন। মৃত্যুর পর তাদের করোনা সন্দেহে মৃত্যু হয়েছে বলে দাফন করা হয়।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা এবং বেসরকারি হাসপাতালে বেশি খরচের ভয়ে শহরের অনেকে হাসপাতালে যেতে চান না। শহরের চেয়ে গ্রামের পরিস্থিতি আরও খারাপ। আর্থিক অবস্থা, হাসপাতালে থাকা–খাওয়া, যাতায়াত, রোগীর সঙ্গে কে থাকবেন— এসব বিবেচনায় রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া একটি বড় সিদ্ধান্তের বিষয়। তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনেকে অপেক্ষা করতে চান। অক্সিজেনের মাত্রা মাপার যন্ত্র অক্সিমিটারও নেই অনেক পরিবারে। নীরবে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলেও বুঝতে পারেন না রোগী। তাই হঠাৎ মৃত্যু হয়।
করোনার ডেলটা ধরনও (ভারতে শনাক্ত) ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অনেকে আবার করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতেও যান না। তাই মৃত্যুর পর তাদের নামও ওঠে না সরকারি তালিকায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জাতীয় ওই দৈনিককে বলেন, হাসপাতাল নিয়ে সাধারণ মানুষের ভীতি আছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম ও চিকিৎসা না পাওয়ার শঙ্কা বাদ দিয়ে সবাইকে হাসপাতালে আসতে হবে। ৪৫ বছরের বেশি বয়সী সবাইকে অবশ্যই চিকিৎসকের অধীনে থাকতে হবে।
করোনার উপসর্গ নিয়ে গ্রামে মৃত্যু বাড়ছে
বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন অনেকে৷ মৃতের সংখ্যা বাড়লেও পরীক্ষা না হওয়াতে করোনার সরকারি পরিসংখ্যানে তা উঠে আসছে না৷ যে কারণে গ্রামের মানুষ পরিস্থিতি আঁচ করতে পারছেন না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
তবে করোনায় মৃত্যু তালিকায় তাদের নাম আসছে না৷ শুধু যারা হাসপাতালে করোনা পজেটিভ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছেন, সেই সংখ্যাটিই করোনায় নিহত বলে লিপিবদ্ধ হচ্ছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনাধীন ‘বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি’ সারাদেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের তালিকা করছে৷ গত মাসের তালিকা এখনও সম্পন্ন হয়নি বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি৷ ফলে এই মুহূর্তে সঠিক সংখ্যাটি বলা সম্ভব না হলেও উপসর্গ নিয়ে মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বলে জানায় তারা৷ এ পর্যন্ত যে তালিকা হয়েছে তাতে জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে উপসর্গ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হতে পারে৷ এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য উপাত্তে সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে বলে দাবি তাদের৷
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামে আক্রান্তদের বেশিরভাগই নমুনা পরীক্ষা করাতে আগ্রহী নন৷ তবে শুধু আগ্রহের ঘাটতি আছে তা নয়৷ সব এলাকায় করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই বলে জানা গেছে৷ যে কারণে অনেকেই ঘরে বসে চিকিৎসা করছেন৷ যাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো তারা হয়তো কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে উঠছেন৷ আবার সর্দি, কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি নিয়ে মারা যাওয়ার ঘটনার খবরও পাওয়া যাচ্ছে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘উপসর্গ দেখা দিলেও গ্রামের মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতে চান না৷ আমি নিজে ঈদের দিন গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি, মানুষের ভয় অনেক কমে গেছে৷ স্বাস্থ্যবিধি মানার আগ্রহ নেই তাদের৷ মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে গ্রামের মানুষকে করোনার বিষয়ে সচেতন করতে জনপ্রতিনিধি, স্বাস্থ্যকর্মী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ ঈদের আগেই এই কমিটি করা হয়ছে৷ উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসা নেওয়া, ঘরে থাকা, আইসোলেশনে রাখা এসব কাজে সহযোগিতা করবে ওই কমিটি৷ দু’এক দিনের মধ্যে আবার এই কমিটিকে কার্যকর করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে৷ দেখেন আমরা তো টেস্টের ব্যবস্থা করেছি৷ এখন মানুষ যদি টেস্ট করাতে না যায় তাহলে আপনি কী করবেন?’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৪
আপনার মতামত জানানঃ