চিকিৎসাখাতের সিন্ডিকেটের কারণে রোগীদের ভোগান্তি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। করোনাকালে মানুষের অসুস্থতা বেড়ে যাবার কারণে এই সিন্ডিকেটগুলোও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠছে। জনগনের করের টাকায় তৈরী হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম গায়েব হয়ে যাচ্ছে। পণ্য না পেলেও বিল পরিশোধন করা হচ্ছে। করোনা সাসপেক্টেড চিকিৎসক-নার্সদের কোয়ারেন্টিনে রাখার জন্য যে দামে হোটেলের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, একটি হাসপাতাল হোটেল মালিককে বিল দেয়া হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি। ওষুধ কেনার ক্ষেত্রেও খুচরো মূল্যের থেকে বেশি দরে পন্য কেনা হচ্ছে যার নিয়ম নেই। মাস্ক, স্যানিটাইজার থেকে শুরু করে করোনা টেস্টের নামে জালিয়াতি করেও হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা। এইসব সিন্ডিকেটের পাল্লায় পড়ে জনগনের দেয়া করের প্রায় ৩০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতাধীন ১৫টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের ওপর করা কমপ্লায়েন্স (সার্বিক মান) নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে করা প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের মহা হিসাবনিরীক্ষক নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয় দুই মাস আগে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠিয়েছে।
২০২০ এর মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরু হবার পর করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতি, বেশি দামে মাস্কসহ সুরক্ষাসামগ্রী কেনা, চিকিৎসকদের উন্নতমানের মাস্কের নামে নিম্নমানের মাস্ক দেওয়া, নিয়োগে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগসহ দুর্নীতি-অনিয়মের নানা ঘটনা বেরিয়ে আসে। সামনে আসে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার নানা ঘাটতিও। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গত জুনে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পদত্যাগেরও দাবি ওঠে। জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ঢালাও অভিযোগ দিলে তো চলবে না।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ইহতেশামুল হক চৌধুরী গনমাধ্যমকে বলেন, ‘কোনো জবাবদিহি নেই বলেই মহামারিকালেও কিছু মানুষ দুর্নীতি করতে পারছে। কর্তাব্যক্তিরা শুধু বলে চলেছেন, তদন্ত প্রক্রিয়াধীন আছে, প্রক্রিয়াধীন আছে। দেড় বছরের বেশি সময়ে একজনেরও শাস্তির নজির দেখতে পেলাম না।’
সবচেয়ে বেশি দূর্নীতি সামনে আসে যে হাসপাতালগুলোয়
সিএজির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসপাতালগুলোতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ৪১৭ কোটি টাকা থেকে খরচ হয় ৩২০ কোটি টাকা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালেই বেশি অনিয়ম পেয়েছে নিরীক্ষা দল। অনিয়ম প্রক্রিয়ায় জড়িত পণ্য সরবরাহকারী বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানও।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি এম ইকবাল আর্সলান গনমাধ্যমকে বলেন, ‘কোভিডের মতো জরুরি পরিস্থিতিতে কেনাকাটায় কিছু ইচ্ছাকৃত, কিছু অনিচ্ছাকৃত অনিয়ম হয়েছে। তবে প্রভাব বিস্তারের ঘটনাও আছে। সিমেন্টের ব্যবসায়ী যখন ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) সরবরাহের কাজ পেল, তখন কাজদাতার কাছে এর কারণ জানতে চাইলাম। জবাব পেলাম, মন্ত্রণালয়ের চাপে তিনি বাধ্য হয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা বাধ্য করেছেন তারা কিন্তু বিলাইয়ের মতো মুখ মুছে ফেলেন। মাঝখানে ফেঁসে যান চিকিৎসকেরা।’
ভুয়া বিল দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ
কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের কোয়ারেন্টিন বাবদ বরাদ্দ ৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে কারাগারে থাকা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদের মালিকানাধীন রিজেন্ট ডিসকভারি ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস আবাসিক হোটেল ও খাবার বিল বাবদ নিয়ে গেছে দুই কোটি ২৭ হাজার টাকা। রিজেন্টের কোনো হোটেল নেই, কোয়ারেন্টিনের জন্য কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তালিকাভুক্ত হোটেলের মধ্যে রিজেন্ট ডিসকভারির নামও নেই।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসপাতাল বিল দিয়েছে হোটেল মিলিনাকে, কিন্তু তা চলে গেছে রিজেন্ট ডিসকভারির হিসাবে। বিলের সঙ্গে হোটেলে অবস্থানকারীদের স্বাক্ষরসহ নামের তালিকাও নেই। কাল্পনিক বিলের বিপরীতে টাকা দেওয়া হয়েছে মো. সাহেদকে। আর মো. সাহেদ অনেকটা প্রশাসনিক ভয়ভীতি দেখিয়ে হোটেল ও খাবার বিল পরিশোধ করতে বাধ্য করেছেন। এমনকি ট্রেজারি থেকে চেক তুলে নিয়ে তিনি চেকের ফটোকপিও জমা দেননি।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহ আগপর্যন্ত কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রীর পরিচালক ছিলেন সারওয়ার উল আলম। গত সোমবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক শিহাব উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। শিহাব উদ্দিন গনমাধ্যমকে বলেন, ‘মো. সাহেদের সঙ্গে চুক্তি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অন্য আপত্তিগুলো ঠিকই আছে। মাঝখানে কিছু সংশোধনও করা হয়েছে।’
প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম উধাও
মুগদা জেনারেল হাসপাতালে যে পরিমাণ এক্স-রে ফিল্ম ও ইনজেকশন থাকার কথা, নিরীক্ষা দল যাচাই করে দেখেছে তা থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকার পণ্য নেই। কেন নেই, দলটিকে এর জবাবও দেয়নি মুগদা জেনারেল হাসপাতাল। ২২ লাখ টাকার ডেঙ্গু এনএসআই ডিভাইসেরও হদিস নেই হাসপাতালে। লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ নামক একটি প্রতিষ্ঠান এগুলো সরবরাহ করেছিল।
মুগদা জেনারেল হাসপাতালের অধ্যক্ষ আহমেদুল কবির গনমাধ্যমকে বলেন, তিনি খোঁজ নেওয়া ছাড়া এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না। গতকাল দুপুরে প্রথম আলোর জিজ্ঞাসা লিখিতভাবে পাঠানোর পর থেকে তিনি আর ফোন ধরেননি।
এদিকে লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজের বিরুদ্ধেও কিছু অনিয়ম পেয়েছে নিরীক্ষা দল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তি ছাড়াই প্রতিষ্ঠানটিকে ২ কোটি ১১ লাখ টাকার পণ্য দেওয়ার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এই কেনাকাটার সময় লেক্সিকোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন হুমায়ুন কবির। তিনি গনমাধ্যমকে বলেন, তিনি গত বছরের আগস্টে ওই কোম্পানি ছেড়ে চলে এসেছেন। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে চান না।
দূর্নীতির তদন্ত চললেও শাস্তির নজির নেই
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ডিভাইস, ট্যাবলেট ও ইনজেকশন সরবরাহ না পেয়েও বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকার। ২০২০ সালের ৩০ মে ৫ হাজার ২৭৭টি ডেঙ্গু পরীক্ষার ডিভাইস সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছিল মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডকে। কোম্পানিটি সরবরাহ করেছে ১০০টি ডিভাইস, অথচ বিল পেয়েছে ৫ হাজার ২৭৭টিরই।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিলুর রেজা এ বিষয়ে গনমাধ্যমকে বলেন, ‘বিল দেওয়ার কারণ হচ্ছে অর্থবছরের বরাদ্দ যাতে ফেরত না যায়। আর ডেঙ্গু ডিভাইসের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ থাকে বড়জোর ছয় মাস। ওই সময় এগুলোর সরবরাহ নিলে বরং নষ্ট হয়ে যেত। বরং পরে যখন দরকার পড়েছে, তখন নিয়েছি। বিল দেওয়ার সময় নিরাপত্তা হিসেবে মেডিটেক থেকে অগ্রিম চেকও নেওয়া হয়েছিল।’
বিএমএ মহাসচিব অধ্যাপক ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কর্তাব্যক্তিরা শুধু বলে চলেছেন, তদন্ত প্রক্রিয়াধীন আছে, প্রক্রিয়াধীন আছে। দেড় বছরের বেশি সময়ে একজনেরও শাস্তির নজির দেখতে পেলাম না।’
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালকের এই দাবির বিষয়ে সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা দলের একজন দায়িত্বশীল সদস্যের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, পণ্য পাওয়ার আগে বিল পরিশোধ করার কোনো বিধান নেই। অনিয়ম করার অংশ হিসেবে এই চর্চাটি করা হয়। এদিকে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে দুটি কার্যাদেশে ক্লিয়ার এজ টেকনোলজি নামের প্রতিষ্ঠানকে ১১ লাখ টাকার ট্যাবলেট ও ইনজেকশন কেনার কাজ দিয়েছিল। এগুলো না পেয়েই বিল দিয়েছে হাসপাতালটি।
বরাদ্দ বিলের থেকে বেশি খরচ হচ্ছে থাকা খাওয়ার পেছনে
এ কাহিনি কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল ও হোটেল ব্লু বার্ডের। গত বছরের ১৩ এপ্রিল প্রথম দফায় চুক্তি হয় যে থাকা-খাওয়া বাবদ ৩০ জনের জন্য জনপ্রতি সাড়ে চার হাজার টাকা করে হোটেল ব্লু বার্ডকে দেওয়া হবে। পরে সংশোধন করে চুক্তি করা হয় জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা করে। কিন্তু ৩০ জনের পরিবর্তে ৬০ জনের নামে সাড়ে চার হাজার টাকা করে বিল দেওয়া হয়। এতে সরকারের ৮০ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয় হয়েছে। দুই চুক্তিপত্রে ব্লু বার্ডের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের গরমিলও রয়েছে।
ঢাকার হোটেল নিউইয়র্ক ও হোটেল ওসমানিতে সাড়ে ১৩ লাখ টাকা থাকা-খাওয়ার বাড়তি বিল দিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ। এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসকে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল বাড়তি বিল দিয়েছে ১৬ লাখ টাকা।
এদিকে ঢাকার হোটেল নিউইয়র্ক ও হোটেল ওসমানিতে সাড়ে ১৩ লাখ টাকা থাকা-খাওয়ার বাড়তি বিল দিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ। এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসকে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল বাড়তি বিল দিয়েছে ১৬ লাখ টাকা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. টিটো মিয়া গত সোমবার গনমাধ্যমকে বলেন, কেনাকাটার কোনো বিষয় তিনি দেখেন না।
অতিরিক্ত টাকায় কেনা হচ্ছে পন্য
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও সরকারি ক্রয়বিধিতে (পিপিআর) বলা আছে, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের (এমআরপি) চেয়ে বেশি দামে পণ্য কেনা যাবে না। নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, আটটি হাসপাতাল তা লঙ্ঘন করেছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল জবাবে বলেছে, ‘লকডাউন’ থাকায় সরবরাহকারীরা ভয়ে তখন হাসপাতালে পণ্যই সরবরাহ করতেন না। বাধ্য হয়ে বেশি দামে পণ্য কেনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এ নিয়ে নিরীক্ষা দলকে তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দেয়নি। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল জানিয়েছে, বাজারদরের চেয়ে কমে পণ্য কিনেছে তারা। মুগদা জেনারেল হাসপাতাল পরে জবাব দেওয়ার কথা বলে এড়িয়ে গেছে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমান গত সোমবার গনমাধ্যমকে বলেন, এমআরপির মধ্যে থেকেই ওষুধ কেনা হয়েছে, যদিও ঘটনাটি তিনি যোগ দেওয়ার আগের। এদিকে বেশি দামে পণ্য কিনে সরকারের ১ কোটি ৫১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি করেছে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সিএজি আহমেদ আতাউল হাকিম গনমাধ্যমকে বলেন, ‘শুধু কোভিড নয়, দুর্নীতিও মহামারি রূপ নিয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী আলোচনার দায়িত্ব এখন সংসদীয় কমিটির। আর চূড়ান্ত বিচারে প্রতিকারের ব্যবস্থা করবেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিব। আমরা এখন প্রতিকারের অপেক্ষায় থাকতে পারি।’
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৩১৩
আপনার মতামত জানানঃ