ই-কমার্সের এই যুগে বাংলাদেশের জন্য একটা বড় ধাক্কা হতে পারে দেশীয় ডিজিটাল কমার্সের শীর্ষ অবস্থানে থাকা ইভ্যালির বন্ধ হয়ে যাওয়া। ২০১৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটি গত আড়াই বছরে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। ইভ্যালি এই বন্ধ হয়ে যাওয়া আদতে কোন লাভের না হলেও, ক্ষতির হবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলে, এই ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটি গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের কাছ থেকে অগ্রীম যে পরিমাণ টাকা নিয়েছে, যার মোট অঙ্ক প্রায় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি, তা পুনরুদ্ধারের কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।
গত ৪ জুলাই, গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (মার্চেন্ট) কাছ থেকে অগ্রিম নেওয়া ৩৩৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ কিংবা অবৈধভাবে সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা করে ইভ্যালি ডটকমের বিরুদ্ধে মামলা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া ইভ্যালির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাওয়া আর্থিক অনিয়মগুলো তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) পৃথক চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়। এরপরই গনমাধ্যম জুড়ে ইভ্যালির দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবেদন। তদন্ত, মামলা, ৩৩৮ কোটি টাকার আফসোস; তবে কোথাও এই টাকা পুনরুদ্ধারের কোনো পরিকল্পনা বা উপায় চোখে পড়েনি। প্রতিদিন সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত, সেই সম্ভাবনাকে আরও দুর্বল করে তুলছে। ইভ্যালি সম্পর্কে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিমাত্রায় নেতিবাচক সংবাদ ও আলোচনা প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ও পণ্যসরবরাহকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে। যার কারণে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষে সাথে পাওনাদারদের দুরুত্ব তৈরি হচ্ছে।
তবে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদকের আবেদনে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের দেশত্যাগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা ছিল সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সঙ্গে আর্থিক লেনদেন স্থগিত রাখার যে সিদ্ধান্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ফোন ভিত্তিক অর্থ স্থানান্তর (এমএফএস) সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আবার শুধু ইভ্যালি নয়, এর সাথে আরও নয়টি প্রতিষ্ঠানের সাথেও লেনদেন সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে বিকাশ। ইভ্যালি ছাড়াও অন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো হল আলেশা মার্ট, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদীনের প্রদীপ, কিউকুম, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস। বিকাশের এই সিদ্ধান্ত দেশের ডিজিটাল কমার্সের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যদিও নিজেদের গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষায় এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে বিকাশ-এর পেমেন্ট গেটওয়ে সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে বলে নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বিকাশ।
চার হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় ডেসটিনি। রাজধানীর কলাবাগান থানায় ২০১২ সালের ৩১ জুলাই এ নিয়ে দু’দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল, নিষ্পত্তি হয়নি এখনও। কেটে গেছে নয় বছর। অথচ এত বছরেও গ্রাহকদের কেউ কোনো টাকা ফেরত পাননি। এছাড়াও এমএলএম মার্কেটিং কোম্পানি ‘ইউনি পে টু ইউ’ গ্রাহকদের ৪২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এনিয়ে এখনও মামলা চলছে। টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। এমন আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। তাই বিকাশের এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল, এই প্রশ্নটা থেকে যায়। গ্রাহকদের টাকা পুনরুদ্ধারে, ইভ্যালির কার্যক্রম চালু থাকা অত্যন্ত দরকারি। এমন কোন পদক্ষেপ যা ইভ্যালি বন্ধ হবার পথকে সহজ করবে, তা নিজেদের পায়ে কুড়োল মারার সামিল। যদিও রেগুলেটরি নীতিমালা অনুযায়ী পেমেন্ট ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পর পুনরায় বিকাশ পেমেন্ট সেবা চালু করা হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেছে বিকাশ।
এক্ষেত্রে আরও একটি ভুল সিদ্ধান্ত ইভ্যালির ই-ক্যাবে সদস্যপদ স্থগিত করা। ইভ্যালির সাথে কোনপ্রকার আলোচনায় না গিয়ে তাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল অবাক করার মতো। এর ফলে ই-ক্যাবের সদস্য হিসাবে দেয়া সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে ইভ্যালি; যা তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে চালিয়ে নিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। রেডজোন এলাকায় পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না। লকডাউনে ইভ্যালির পণ্য ডেলিভারি অনেক কমে আসবে। যা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। আর আপাতদৃষ্টিতে যেহেতু করোনা মহামারি থেকে দ্রুত মুক্তির কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, তাই ই-ক্যাবের সদস্যপদ হারানো ইভ্যালির জন্য আরেক বিপদ।
ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত বা বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা মালিকপক্ষের সাজা হওয়ার সাথে গ্রাহকদের স্বার্থের সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা করতে চায়, তাহলে এইমুহূর্তে তাদের একটি মধ্যস্ততায় আসা প্রয়োজন। যেখানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে তাদের পাওয়া টাকা ইভ্যালি থেকে ফেরত পাবে; এই শর্তে তারা গ্রাহক সেবা অব্যাহত রাখবে। খাদের কিনারে গ্রাহকদের প্রায় ৩৩৮ কোটি টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইভ্যালির বন্ধ হওয়া, কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক হবে না।
এদিকে, ইভ্যালি গিফট ভাউচারের মূল্য পরিশোধ না করায় গ্রাহকদের কাছে পণ্য সরবরাহ করছে না ইভ্যালির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্র্যান্ডগুলো। তারা গ্রাহকদের বলছে, কোম্পানিটির গিফট ভাউচার গ্রহণ করা হবে না, ইভ্যালির কাছ থেকেই পণ্য বুঝে নিতে হবে। গত ১৪ই জুলাই ক্রেতাদের উদ্দেশে এরকম বেশ কয়েকটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ট্রেন্ডজ, রঙ বাংলাদেশ, আর্টিসান আউটফিটার্স, ফিট এলিগ্যান্স, রিও ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া কোনো কোনো ব্র্যান্ড ক্রেতাদের মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েও সতর্ক করেছে। এসবই ঘটছে ইভ্যালির বিরুদ্ধে সামাজিক ও গণমাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত নেতিবাচক প্রচারণার কারণে।
এক্ষেত্রেও গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়নি। আমাদের মনে করা উচিত, ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত বা বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা মালিকপক্ষের সাজা হওয়ার সাথে গ্রাহকদের স্বার্থের সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যদি গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা করতে চায়, তাহলে এইমুহূর্তে তাদের একটি মধ্যস্ততায় আসা প্রয়োজন। যেখানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে তাদের পাওয়া টাকা ইভ্যালি থেকে ফেরত পাবে; এই শর্তে তারা গ্রাহক সেবা অব্যাহত রাখবে। খাদের কিনারে গ্রাহকদের প্রায় ৩৩৮ কোটি টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইভ্যালির বন্ধ হওয়া, কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক হবে না। আর এইখানে গেম চেঞ্জার হতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিজে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ইভ্যালিকে মনিটরিংয়ে রাখা যেতে পারে। সচল রাখতে প্রয়োজনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রসাশক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে মনিটরিংয়ের জন্য। দেশের বর্ধিঞ্চু এই ডিজিটাল কমার্স ক্ষেত্রটি নিয়ে বিতর্ক বেশ পুরনো। পণ্য কিনে ভোক্তাদের ঠকে যাওয়া, বিক্রেতা কর্তৃক নিম্নমানের পণ্য প্রদান, টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়া, পণ্য বিক্রির পরেও গ্রাহক কর্তৃক পণ্য গ্রহণ না করা বা ফিরিয়ে দেওয়াসহ কিছু ই-কমার্স কোম্পানির অনেকটা ব্যাংকের মতো আচরণ করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। পণ্য কিনে অনেক ক্রেতার প্রতারিত হওয়ারও অভিযোগ এসেছে। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিম এক্ষেত্রে কতটা সফল, তার বড় উদাহরণ ইভ্যালি নিজেই।
ইভ্যালি এবং অভিযুক্ত অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন অব্যবস্থাপনার জন্য সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ই-কমার্স ব্যবসায়ী সমিতি ‘ই-ক্যাব’ এর দায়ও কোন অংশে কম নয়। বাংলাদেশের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিকখাতের এতদিন পার পার করার পরও সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে না পারার ব্যর্থতা কোনভাইবেই এই দু’টি প্রতিষ্ঠান এড়াতে পারেনা। ই-কমার্স ব্যবসার যদি সুনির্দ্দিষ্ট নীতিমালা থাকত আইনী কাঠামোর আওতায়, তাহলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এমন অব্যস্থাপনা চর্চা করার সুযোগ পেত না। সম্ভবনাময় এই খাতটির মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার পর অবশেষে সরকার ই-কমার্সখাতের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে।
এতদিনের নীতিমালাহীন ই-কমার্স খাতটির অব্যবস্থাপনায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকা উচিত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত, সম্প্রতি জারিকৃত সরকারের জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি-২০২০-এর আলোকে তৈরিকৃত নির্দেশিকা অনুযায়ী ইভ্যালির সঠিক মনিটরিং করা, ইভ্যালিকে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া এবং ইভ্যালির নীতিমালা বিশ্লেষণ করে গ্রাহক ও বিনিয়োগদের অর্থ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত করা।
যেমন গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছানোর আগে দেশের ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর টাকা না পাওয়ার যে সিদ্ধান্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি সময়ে নিয়েছে, তা ছিল সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইনে কেনাকাটার প্ল্যাটফর্মগুলো নিয়ে অভিযোগ ও সময়মত পণ্য পেতে ভোগান্তির প্রেক্ষাপটে এমন সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ইভ্যালিকে সরকারের প্রণীত ডিজিটাল কমার্সের নীতিমালার মধ্যে রেখে সচল রাখাই এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
ইভ্যালির বন্ধ হয়ে যাওয়াটা শুধুমাত্র গ্রাহক বা বিনিয়োগদের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইভ্যালি বন্ধ হলে, দেশের ডিজিটাল কমার্স ক্ষেত্রটি বাইরের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানরা দখল করে নেবে। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দাপট চলছে। আলিবাবা, আমাজন এখনি এদেশে ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল মার্কেট নিজেদের আয়ত্ত্বে নিতে চায়; এটা সম্ভব হলে তা আমাদের জন্য সাময়িক লাভের হলেও, দীর্ঘমেয়াদে আমরা এই ক্ষেত্রটির উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবো।
তবে আশার কথা আজ (১৮ জুলাই) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বাংলাদেশের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে আসা গ্রাহকদের অভিযোগ কীভাবে যাচাই করা হবে এবং সেই অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে দায়বদ্ধ করা সম্ভব, এ নিয়ে আলোচনা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে বলেন, দেশের সব ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে ভোক্তারা যেসব অভিযোগ করেন, সেই অভিযোগগুলো যেন একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছে আসে, সেরকম প্রযুক্তি প্রস্তুত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর ফলে কর্তৃপক্ষ সরাসরি ভোক্তাদের অভিযোগগুলো যাচাই করতে পারবে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), বাংলাদেশ ব্যাংক এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে এই নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
ইভ্যালির বন্ধ হয়ে যাওয়াটা শুধুমাত্র গ্রাহক বা বিনিয়োগদের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইভ্যালি বন্ধ হলে, দেশের ডিজিটাল কমার্স ক্ষেত্রটি বাইরের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানরা দখল করে নেবে। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দাপট চলছে। আলিবাবা, আমাজন এখনি এদেশে ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল মার্কেট নিজেদের আয়ত্ত্বে নিতে চায়; এটা সম্ভব হলে তা আমাদের জন্য সাময়িক লাভের হলেও, দীর্ঘমেয়াদে আমরা এই ক্ষেত্রটির উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবো। খুব কাছাকাছি সময়েই, ডিজিটাল কমার্স সবথেকে বড় মার্কেট প্লেস হয়ে উঠবে।
এদিকে, একই সুরে গতকাল (শনিবার) ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল তার ফেসবুক আইডিতে লেখেন,
ইভ্যালির পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত সোস্যাল মিডিয়াতে পেয়েছি এবং দেখেছি। এতদিন ইভ্যালির যে লস সেটা শুধুমাত্র বিজনেস ডেভেলপমেন্ট এর এই ইনভেস্টমেন্ট গিয়েছে। এখন ইভ্যালির অর্গানিক সেলস অনেক বেড়েছে। অনেকে এই সময় মতামত দিচ্ছেন বন্ধ করে পুরাতন অর্ডার ডেলিভারি করা হোক।
কিন্ত এখন তো আমরা অগ্রিম টাকা পাই না। গত দুই সপ্তাহ কিভাবে তাহলে পুরাতন অর্ডার থেকে ৪০ কোটি টাকার অধিক ডেলিভারি করা হলো?
আমরা বড় বড় সেলারদের ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি পেমেন্ট দিয়েছি। তারা আমাদের পাশে থাকতে চান। কিন্ত মিডিয়া অথবা সোস্যাল মিডিয়া যখন ডেসটিনি’র মত কোম্পানির সাথে তুলনা করেন তখন যে কেউই ভয় পেয়ে যান। আমরা বিজনেস সবাই বুঝি। এটা একটা চলমান সম্পর্কে থাকার বিষয়। সেলস থাকলে সেলার থাকবে। এবং সেলার থাকলে পণ্য থাকবে।
আমাদের এই বিজনেস ডেভেলপমেন্ট এ সবচেয়ে বড় বাধা ছিল দেশি অথবা বিদেশি বিনিয়োগ। কেউ কি আমাকে দয়া করে কোনো আইনী ধারা উল্লেখ করতে পারেন যেটি হয়তো আমার অজান্তেই মিস করে গেছি। যে কারণে আপনি বলতে পারেন ইভ্যালি অবৈধ। যদি নাই হয়, মিডিয়ায় অথবা সোস্যাল মিডিয়ায় আমাকে ক্রিমিনাল না বানিয়ে বিচার না করার অনুরোধ করতে পারি শুধু।
আমি বাংলাদেশের সব বড় গ্রুপ এখন যাচ্ছি। আমার হয়তো পুঁজি ঘাটতি। কেউ পুঁজি দিলেই কিন্ত কাল আমাকে সবাই হিরো বলত। যেই জিনিসটা ইভ্যালি অর্জন করতে চেয়েছিল, ইভ্যালি একদম সেটার দ্বারপ্রান্তে। এতো কিছুর পর নতুন নীতিমালার আলোকে ইভ্যালির সেলস ১০০ কোটি টাকা (পেইড)। এই সময় এসে গঠনমূলক অথবা পরামর্শমূলক আলোচনা অবশ্যই সবার উপকার হবে।
ইভ্যালি নিয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী। এবং এর চেয়েও বেশি আশাবাদী ইকমার্স নিয়ে। বিদেশী আমাজন আসলে আমরা খুশি হব স্বাভাবিক। কিন্ত দেশের কেউ ইকমার্স লিড দিবে এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত। কারণ আমরা এখন সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল জাতি। আমাদের একটু সময় দিন।
সর্বশেষ সোমবার গভীর রাতে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মোহাম্মদ রাসেল তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে জানান, “আমি কনফিডেন্টলি বলতে পারি বর্তমান নীতিমালা মেনে বিজনেস করে ইভ্যালি সকল পেন্ডিং অর্ডার ডেলিভারি করবে। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।”
৫ জন কর্মী নিয়ে ইভ্যালির যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীসংখ্যা ৭ শতাধিক। ইভ্যালি বর্তমানে ৪ হাজার কোটি টাকার কোম্পানি। ইভ্যালি ৩৭ লাখ গ্রাহক নিয়ে বর্তমানে দেশের ই-কমার্স খাতে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে বলে এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রাসেল দাবি করেন। আর এদিকে ইভ্যালির বিরুদ্ধে আসা বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দিতে প্রতিষ্ঠানটিকে ‘কারণ দর্শানোর সুযোগ’ দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ। রবিবার বিকেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে তারা যেই টাকা নিয়েছে, তা তারা কীভাবে ফেরত দেবে সেই বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হবে। এছাড়া শুধু ইভ্যালি নয়, সার্বিকভাবে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, সেবিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বৈঠকে।
ইভ্যালিকে তাদের বিজনেস প্ল্যান ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেয়া হবে সংশ্লিষ্ট একটি কমিটির কাছে। কমিটি যাচাই করবে যে তারা আসলেই ভোক্তাদের কাছ থেকে নেয়া টাকা ফেরত দিতে পারবে কিনা। কমিটি যদি তাদের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয় তাহলে প্রয়োজনে তাদের সুযোগ দেবে। কমিটি চাইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করতে পারে।
এর মাঝেই ফেসবুকে সেভ ইভ্যালি, সেভ ই-কমার্স হ্যাশট্যাগে মানুষ ইভ্যালির পাশে দাঁড়াচ্ছে। ই-কমার্স কাস্টমার কমিউনিটিতে শেখ জুবায়ের মিশু বলেছেন, ইভ্যালিকে ভিলেন বানিয়ে আপনারা লক্ষ লক্ষ গ্রাহককে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন? মাথা ব্যাথায় মাথা কেটে ফেলা কোন সমাধান না! ইভ্যালির ভুল গুলো ধরিয়ে দিন। কীভাবে গ্রাহক ও সেলারদের বকেয়া পরিশোধ করতে পারে সে ব্যাপারে ব্রিফ করুন। প্রয়োজনে কড়া নজরদারির মাধ্যমে মনিটরিং করুন। নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা হোক। ইভ্যালির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে গ্রাহক ও সেলারদের ভিতর আতঙ্ক ও ভীতি তৈরী করে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে অথবা জোর করে ক্ষমতা দিয়ে বন্ধ করে দিলে লক্ষ লক্ষ গ্রাহক ও ক্ষুদ্র বিক্রেতারা পথে বসে যাবে।
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী জুয়েল বলেন, যারা মনে করছেন ইভ্যালি চলে গেলে অন্য ই-কমার্স ভালো সার্ভিস দিবে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ইভ্যালির কনসেপ্ট নিয়েই অনেকে ব্যবসা শুরু করেছে। ইভ্যালিতে যারা প্রথম থেকে কেনাকাটা করেন, তারা কেউ চাইবে না ইভ্যালি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। কারন তারা সবাই প্রয়োজনীয় অনেক কিছু ইভ্যালির মাধ্যমে কম দামে কিনেছে। হকার্স মার্কেটের ক্রেতাকে ব্র্যান্ডের শোরুমের মর্যাদা ইভ্যালি দিয়েছে। যে মানুষটা কখনো স্যামসাং প্রডাক্ট কিনবে চিন্তাও করতে পারেনি, তার বাড়িতে ফ্রীজ, টিভি, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন সব স্যামসাং ব্র্যান্ডের। মূল কথা হলো ইভ্যালি বাঁচলে অনেক মধ্যবিত্তের স্বপ্ন পূরণ হবে। জানি তারা লেট ডেলিভারি দেয়, আর সেটা জেনেই তো সবাই অর্ডার করে। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে এই ই-কমার্সের পক্ষে বলুন। কারন না হলে অনেক গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের ই-কমার্স ও গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় ইভ্যালিকে টিকিয়ে রাখাটা এখন বড় চ্যালেঞ্জের।
আপনার মতামত জানানঃ