গত দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাসে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে মানুষ। তার সঙ্গে লকডাউনের জেরে রোজগারশূন্য হয়ে পড়েছেন অনেকে। তাই দুই বেলা দুই মুঠো খাবার জোগাড় করাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাঁচার তাগিদে বিক্রি করছে কিডনি। করোনায় বেড়েছে দরিদ্রতার হার। আছে আর্থিক মন্দা, লকডাউন, চাকরি খোয়ানো। সব মিলিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি গোটা বিশ্বে। দুর্দশা চরমে ভারতেরও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিইডব্লু রিসার্চ সেন্টারের প্রতিবেদনে দাবি, লকডাউনে চাকরি হারানোর কারণে প্রায় ৭৫ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে।
কাজ হারিয়ে বিক্রি করছে কিডনি
এমনিতেও স্বচ্ছলতা তাদের ঘরের মুখ দেখে না। অধিকাংশই দিনমজুর। বাড়তি সঞ্চয় নেই কোনও। আর করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ। পকেট ফাঁকা, পেটেও ক্ষুধা।
দুই বেলা ঠিক মতো খাওয়ার আশায় তাই কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। এরই মধ্যে অন্তত ১২ জনের সন্ধান মিলেছে, যারা দারিদ্রের ছোবল থেকে বাঁচতে কিডনি বিক্রি করেছেন।
ভারতের আসামের ধরমতুল গ্রামের পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ওই গ্রামের দিনমজুররা নিজের কিডনি বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন।
এমনই একজন ৩৭ বছরের সুমন্ত দাস। পেশায় রাজমিস্ত্রি হলেও লকডাউনে বেকার। একদিকে ঘরে চাল নেই, অন্যদিকে ছেলের অপারেশন করাতে হবে। ঋণের বোঝাও রয়েছে।
তাই বাধ্য হয়ে ৫ লাখ রুপির জন্য নিজের কিডনি বিক্রি করে দেন তিনি। কিন্তু দালালরা তাকে দেড় লাখ রুপির বেশি দেননি। ওই টাকায় ছেলের অপারেশন হয়নি। এদিকে কিডনি হারিয়ে তিনিও ভারী কাজ করতে পারছেন না।
পুলিশ জানিয়েছে, দরিদ্র মানুষদের নানাভাবে রাজি করান একদল দালাল। তারা এরই মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছে।
জানা গেছে, ওই নারী ও তার ছেলে বিভিন্ন পরিবারের কাছে গিয়ে কিডনি বিক্রি করতে উসকানি দিতো। পুলিশ দুজনকেই গ্রেফতার করেছে। চক্রের মূলহোতাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সুমন্তর মতো হতভাগ্য আরও অনেকই রয়েছেন। কৃষ্ণা দাস নামে এক নারীর স্বামীও একইভাবে দালালদের টোপে পা দিয়েছেন। কিডনি বেচে সাড়ে চার লাখ রুপি দেয়ার কথা বলা হলেও পেয়েছেন মাত্র ১ লাখ রুপি। এদিকে মাথার উপরে ঝুলছে ৭০ হাজার রুপির ঋণের বোঝা।
কিডনি হাতিয়ে নেয়া এই চক্রকে নির্মূল করতে সক্রিয় হয়েছে আসাম পুলিশ। এ নিয়ে তদন্তও শুরু করেছে তারা।
জানা যায়, বহু গ্রামবাসীর মতে দারিদ্রের প্রকোপে পড়া অবস্থায় সহজে অর্থ রোজগারের টোপ এড়াতে পারেননি তারা। আর তাই কলকাতায় গিয়ে কিডনি বিক্রি করে আসছেন। তবে লকডাউনের আগে থেকেই এই চক্র সক্রিয় ছিল বলে দাবি।
পরিস্থিতির সুযোগে যা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পুলিশ এই চক্রকে নির্মূল করতে সচেষ্ট হয়েছে। যারা কিডনি দিয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে দালালদের খোঁজ করা হচ্ছে। এই চক্র কতদূর ছড়িয়ে রয়েছে তা জানতে তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
এদিকে অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈর পুত্র তথা কংগ্রেস নেতা গৌরব গগৈ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার আরজি জানিয়েছেন।
তার চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন এই কিডনি পাচারকারী চক্রের যোগ রয়েছে কলকাতার সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীকে শহরের পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি।
৭৫ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে
আর্থিক মন্দা, লকডাউন, চাকরি খোয়ানো- সব মিলিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেশে। এমনই তথ্য তুলে ধরেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিইডব্লু রিসার্চ সেন্টার। তাদের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে লকডাউনে চাকরি হারিয়ে প্রায় ৩২ মিলিয়ন ভারতীয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের কেউ নিম্ন মধ্যবিত্ত, আবার কেউ দরিদ্রতে পরিণত হয়েছেন।
এই সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, দরিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা লকডাউনে বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ।
রিপোর্ট অনুযায়ী ৭৫ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে চলে গিয়েছেন। আরও জানা গিয়েছে, দিন প্রতি যেসব ভারতীয় ৭০০ থেকে ১৪০০ টাকা রোজগার করতেন, মন্দার কোপ এসে পড়েছে সবথেকে বেশি তাদের ওপর।
অর্থনৈতিক মন্দার আগে ভারতে মধ্যবিত্ত ছিলেন প্রায় ৯৯ মিলিয়ন, সেই সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ৬৬ মিলিয়নে। বিশ্ব ব্যাংকের দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিইডব্লু রিসার্চ সেন্টার। দরিদ্রদের সংখ্যা আচমকাই বেড়ে গিয়েছে ভারতে বলে জানানো হয়েছে।
২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে ঢুকে পড়েছিলেন প্রায় ৫৭ মিলিয়ন মানুষ। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ভারত ও চিনের প্রায় সমান অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার দেখা গিয়েছিল।
তবে পরিস্থিতি পালটে যায় লকডাউনে। চাকরি খুইয়ে, কাজ হারিয়ে সর্বস্বান্ত মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে চলে আসে দরিদ্রসীমায়। পরিস্থিতি বদলায়নি এখনও। করোনা সংক্রমণ আবারও নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে। ফলে আর্থিক মন্দার কোপ যে এত তাড়াতাড়ি বদলাবে, সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ