হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষ একেবারেই আলাদা, অনন্য— এমনটা ভেবে নেওয়া খুবই সহজ। কিন্তু এমন একটা সময় ছিল, যখন পৃথিবীর বুকে হোমো স্যাপিয়েন্স ছাড়াও মানুষের অন্যান্য প্রজাতির বাস ছিল।
প্রায় ৩ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে আফ্রিকার বুকে হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভবের সময় থেকেই নিয়ান্ডারথালস, ডেনিসোভান্স, হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস, হোমো লুজোনেনসিস ও হোমো নালেদিসহ মানুষের অনেক প্রজাতির বাস ছিল পৃথিবীতে। এসব প্রজাতির অনেকের সঙ্গে স্যাপিয়েন্সরা বংশবৃদ্ধিও করেছে। এদের অনেকেরই ফসিল রেকর্ড সংরক্ষিত আছে, তবে আমাদের ডিএনএ থেকেই ডেনিসোভানদের সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিনিয়তই মানব বিবর্তনের ব্যাপারে আমরা যা জানি তাতে পরিবর্তন আসছে। বিলুপ্ত পূর্বসূরীদের সঙ্গে আধুনিক মানুষের জিনগত পার্থক্য বা মিল আরও সূক্ষ্মভাবে নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে।
নতুন গবেষণায় প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে, প্রাগৈতিহাসিক মানবের সঙ্গে আধুনিক মানুষের পার্থক্যের চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে মিল। দুই দলের ডিএনএতে, অর্থাৎ জিনগত পার্থক্যের তুলনায় মিল ১২ গুণ বা প্রায় ৯৩ শতাংশ।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্স অ্যাডভান্সেসে শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে ‘অ্যান অ্যান্সেসট্রাল রিকম্বিনেশন গ্রাফ অফ হিউম্যান, নিয়ান্ডারথাল অ্যান্ড ডেনিসোভান জিনোমস’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি।
এতে বলা হয়, প্রাগৈতিহাসিক মানবের সঙ্গে আধুনিক মানুষের ডিএনএর পার্থক্য মাত্র সাত শতাংশ।
প্রতিবেদনের সহ-লেখক ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার কম্পিউটেশনাল বায়োলজিস্ট নাথান শেফার বলেন, ‘পার্থক্যের হার খুব সামান্য। গবেষণার এ ধরনের ফলের কারণে নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে আমাদের— অর্থাৎ এখনকার মানুষ ভিন্ন বলে যে প্রচলিত ধারণা ছিল, তা থেকে সরে আসছেন গবেষকরা।’
বিজ্ঞানের পরিভাষায় মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্সের আদি রূপ হলো নিয়ান্ডারথাল। প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুক থেকে নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়।
এখনকার মানুষের মধ্যে নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএর সামান্য অংশ বিদ্যমান বলে একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও ইদানিং বিজ্ঞানীদের সে অবস্থান কিছুটা নড়বড়ে।
প্রাগৈতিহাসিক মানবের সঙ্গে আধুনিক মানুষের ডিএনএর পার্থক্য মাত্র সাত শতাংশ।
অর্ধলাখ বছর আগে বিলুপ্ত নিয়ান্ডারথাল আর ডেনিসোভান্সের জীবাশ্ম থেকে সংগৃহীত ডিএনএ আর বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৭৯ জন মানুষের ডিএনএর পার্থক্য বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে নতুন গবেষণায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভান্সের সঙ্গে আধুনিক মানুষের ডিএনএতে মিল থাকার বিষয়টি আগেই জানা গিয়েছিল।
নতুন গবেষণায় নতুন যে তথ্য মিলেছে, তা হলো— প্রাগৈতিহাসিক মানবের সঙ্গে বর্তমানের একেকজন মানুষের ডিএনএর একেকটি অংশের মিল আছে।
নতুন গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য ছিল আধুনিক মানুষের ডিএনএর কতোটুকু নতুন, তা নির্ণয় করা। অর্থাৎ নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভান্সের ডিএনএর তুলনায় মানুষের ডিএনএ কতোটা ভিন্ন, তাই জানতে চেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু এই ধরনের সংখ্যাভিত্তিক পার্থক্য নির্ণয় কঠিন। তাই এ গবেষণার জন্য নতুন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এ পদ্ধতিতে প্রাচীন জিনোমের হারিয়ে যাওয়া তথ্যের হিসাব বের করা হয়।
গবেষকরা দেখেছেন, আমাদের জিনোমের খুব ক্ষুদ্র অংশ— মাত্র দেড় শতাংশ— একইসঙ্গে আদিম মানবের চেয়ে ভিন্ন এবং বর্তমানে জীবিত সব মানুষের মধ্যে বিদ্যমান।
ধারণা করা হচ্ছে, এই দেড় শতাংশ ডিএনএ থেকেই জানা যাবে যে ঠিক কোন কারণ সত্যিকার অর্থে আধুনিক মানুষকে পূর্বসূরী থেকে আলাদা করেছে?
গবেষণা প্রতিবেদনটির আরেক সহ-লেখক ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া স্যান্টা ক্রুজের কম্পিউটার বায়োলজিস্ট রিচার্ড গ্রিন বলেন, ‘জিনোমের এই অংশগুলো খুবই সমৃদ্ধ ও তথ্যবহুল বলে আশাবাদী আমরা। ধারণা করছি, স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ আর মস্তিষ্কের কাজ পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব অংশ।’
সম্প্রতি চীনে পাওয়া এক লাখ ৪০ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগের মানুষের মাথার খুলির সঙ্গে আধুনিক মানুষের খুব কাছাকাছি মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, উত্তর-পূর্ব চীনে পাওয়া এসব খুলির অধিকারী মানুষদের সঙ্গে নিয়ান্ডারথাল মানুষের চেয়ে আমাদের আধুনিক মানুষের মিলই বেশি।
প্রায় অবিকৃত অবস্থায় যে খুলিটি পাওয়া গেছে, সেটি একজন মধ্যবয়সী মানুষের। কোটরে ঢোকানো চোখ, মোটা ভ্রূ। প্রশস্ত মুখমণ্ডল আর সরু চিবুক। চেহারার এ বৈশিষ্ট্যগুলো ওই খুলির অধিকারীকে মানবপরিবার বৃক্ষের অন্যান্য অস্তিত্বশীল সদসদের চেয়ে আধুনিক মানুষের নিকটাত্মীয়ের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
বিবর্তনের ধারায় আধুনিক মানুষের সব আত্মীয়রাই আজ বিলুপ্ত। শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বোনোবো, ওরাংওটাং ও মানুষ নিয়ে গঠিত পরিবারের নাম গ্রেট এপ। আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জিরাই। একটা সময় ছিল, যখন শিম্পাঞ্জি ও মানুষকে আলাদা করা যেত না। শিম্পাঞ্জি ও মানুষের আলাদা হওয়াটা মাত্র ৭০ লক্ষ বছর আগে, ইতিহাসকে জীবন্ত করে জীবাশ্ম বা ফসিল। সেই সময়ের শিম্পাঞ্জিদের কোনও জীবাশ্মীভূত হাড়গোড় পর্যন্ত নেই। বিচ্ছেদের সেই ইতিহাস তাই আজও অজানা। মানুষের বংশলতিকার কাঠামো বারেবারে পরিবর্তিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভানদের ফসিলের উপস্থিতি বিবর্তনের ইতিহাসকে নতুন মাত্রা ও দিশা দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ