করোনার অতি সংক্রামক পরিবর্তিত ধরন ডেল্টার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানোম গ্যাব্রিয়েসুস। একই সাথে কারণ হিসাবে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রমাণিত ব্যবস্থাগুলোর সামঞ্জস্যহীন ব্যবহারকেও দেখছেন।
বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় ডব্লিউএইচও কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাপরিচালক বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বজুড়ে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে এবং আমরা বর্তমানে এর প্রাথমিক পর্যায়ে আছি।’
বিশ্বে নতুন করে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা কেন বাড়ছে, তার প্রধান কারণগুলো উঠে এসেছে ডব্লিউএইচওর মহাসচিবের কথায়। তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু উভয় বাড়ার পেছনে মুখ্য কারণ হিসেবে কাজ করছে— ডেলটা ধরনের বিস্তার, সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রমাণিত ব্যবস্থাগুলোর সামঞ্জস্যহীন ব্যবহার।
তেদরোস আধানোম গ্যাব্রিয়েসুস বলেন, একটা সময় বিশ্বে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু ধারাবাহিকভাবে কমছিল। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সারা বিশ্বেই করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু নতুন করে বাড়ছে। এই প্রবণতায় তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
করোনাভাইরাসের বিবর্তন বা রূপ বদল অব্যাহত আছে বলে উল্লেখ করেন ডব্লিউএইচওর মহাসচিব। তিনি বলেন, এই বিবর্তনের কারণেই অধিক সংক্রামক ধরনগুলো আসছে।
গ্যাব্রিয়েসুস জানান, ভাইরাসটি বিকশিত হওয়া অব্যাহত রেখেছে, যার মাধ্যমে অধিক সংক্রামক ধরনগুলো তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ১১১টির বেশি দেশে পৌঁছে গেছে। আমরা ধারণা করছি, এটি শিগগিরই বিশ্বজুড়ে করোনার সবচেয়ে প্রভাবশালী ধরন হিসেবে আবির্ভূত হবে, যদি না তা ইতোমধ্যেই হয়ে গিয়ে থাকে।’
গত সপ্তাহে টানা চতুর্থ সপ্তাহের মতো বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণের হার বাড়তে দেখা গেছে। এর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি অঞ্চলের মধ্যে একটি বাদে সবগুলোতেই রেকর্ড সংখ্যক সংক্রমণ হয়েছে। টানা ১০ সপ্তাহ কমার পর সম্প্রতি করোনায় মৃত্যুও ফের বাড়তে শুরু করেছে।
করোনার এই ভয়াবহতা ঠেকাতে টিকাদানের বিকল্প নেই বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন ডব্লিউএইচও প্রধান। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিটি দেশের অন্তত ১০ শতাংশ মানুষকে করোনা টিকার আওতায় আনতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানের কথাও ফের উল্লেখ করেন তিনি।
টিকা সরবরাহ-বণ্টনের বৈশ্বিক বৈষম্য নিয়ে কথা বলেন ডব্লিউএইচওর প্রধান। এই বৈষম্যকে বেদনাদায়ক হিসেবে অভিহিত করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তেদরোস আধানোম গ্যাব্রিয়েসুস বলেন, এই বৈষম্য দুটি ধারার (ট্র্যাক) জন্ম দিয়েছে। তার একদিকে রয়েছে, যাদের অনেক টিকা রয়েছে, এমন দেশগুলো। তারা বিধিনিষেধ তুলে নিচ্ছে। সবকিছু খুলে দিচ্ছে। আর এই ধারার অন্যদিকে রয়েছে সেই সব দেশ, যাদের টিকা নেই। তাদের জীবন করোনাভাইরাসের দয়ার ওপর নির্ভর করছে।
ডব্লিউএইচওর প্রধান বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ এখন পর্যন্ত কোনো টিকাই পায়নি। আর যেসব দেশ টিকা পেয়েছে, তাদের অধিকাংশ যথেষ্টসংখ্যক পায়নি।
তবে শুধু টিকা দিয়ে এই মহামারিকে থামানো যাবে না বলেও উল্লেখ করেন তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। এ জন্য তিনি করোনা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ কৌশলগুলো অনুসরণ করে যেতে দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
গত এক সপ্তাহে সারা বিশ্বে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের নতুন করে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। একই সময়ে মারা গেছেন ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ।
টিকা বৈষম্য দুটি ধারার (ট্র্যাক) জন্ম দিয়েছে। তার একদিকে রয়েছে, যাদের অনেক টিকা রয়েছে, এমন দেশগুলো। তারা বিধিনিষেধ তুলে নিচ্ছে। সবকিছু খুলে দিচ্ছে। আর এই ধারার অন্যদিকে রয়েছে সেই সব দেশ, যাদের টিকা নেই। তাদের জীবন করোনাভাইরাসের দয়ার ওপর নির্ভর করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগের এক সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে শনাক্ত প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।গতকাল বুধবার জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারিসংক্রান্ত সাপ্তাহিক বুলেটিনে বলা হয়, ৫ থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত সারা বিশ্বে ২৯ লাখ ৯৬ হাজার ৪৬৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এই সময় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫৫ হাজার ৮৩০ জন।
মহামারির বিস্তার বাড়তে থাকার মধ্যেই ১১তম দেশ হিসেবে লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনায় বুধবার করোনায় মৃত্যু এক লাখ ছাড়িয়েছে। চলতি সপ্তাহে করোনায় রেকর্ড মৃত্যু দেখেছে রাশিয়া। বেলজিয়ামে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাড়ছে ডেল্টার সংক্রমণ; এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এ সংখ্যা। যুক্তরাজ্যে ছয় মাসে প্রথমবার এক দিনে ৪০ হাজারের বেশি মানুষের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মিয়ানমারে দিন-রাত চলছে মরদেহ সমাধিস্থ করার কাজ। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় এক হাজার মৃত্যু দেখেছে ইন্দোনেশিয়া; দিনে নতুন শনাক্ত ৫৪ হাজারের বেশি, যা এক মাস আগেও ছিল আট হাজারের নিচে।
বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে করোনা প্রতিরোধে গণটিকাদান চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু সেখানেও গত দুই সপ্তাহে শনাক্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গড় ২৪ হাজার ছাড়িয়েছে। যদিও দৈনিক মৃত্যু এখনও নিম্নমুখী।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর লস অ্যাঞ্জেলেসে মঙ্গলবার টানা পঞ্চম দিনের মতো দৈনিক শনাক্ত এক হাজারের বেশি ছিল। শিকাগোতে বাইরে থেকে শহরে আসা মানুষজনকে টিকা না নেয়া থাকলে হয় কোভিড নেগেটিভ টেস্ট দেখাতে হবে, না হলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
কানেক্টিকাটে জরুরি ব্যবস্থার সময় বাড়াতে পার্লামেন্টে ভোট হয়েছে। মাস্ক না পরলে টিকা থাকার প্রমাণ সঙ্গে রাখতে হবে বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে অ্যালাবামার সামরিক ঘাঁটি থেকে।
এশিয়ায় করোনার বিস্তার ঊর্ধ্বমুখী বলে চতুর্থবারের মতো চলতি মাসে জরুরি অবস্থা জারি করেছে জাপান। দেশটিতে দ্রুত হাসপাতাল ভরে যাচ্ছে রোগীতে। সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্তের পর দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজধানী সিউলে এযাবৎকালের কঠোরতম সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় ৫০ লাখ বাসিন্দার সিডনিতে জারি করা হয়েছে কঠোর লকডাউন, যা চলবে কমপক্ষে চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত।
ইউরোপের মধ্যে স্পেনের বার্সেলোনায় রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়েছে। লন্ডনে বাস ও ট্রেনে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র সাদিক খান। বিদেশগামী সকলকে দেশে ফিরতে হলে কোয়ারেন্টিনের শর্ত পূরণ করতে হতে পারে বলে সতর্ক করে ইতালি।
বিশ্বজুড়ে করোনা প্রতিরোধী গণটিকাদান কার্যক্রম চলছে সাত মাস ধরে।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, দিনে বৈশ্বিক মৃত্যু কমেছে প্রায় আট হাজার করে, জানুয়ারিতে যা ছিল ১৮ হাজারের বেশি। দৈনিক সংক্রমণ এখন সাড়ে চার লাখের নিচে, যা এপ্রিলের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
এমন সময়ে অনেক দেশের ওপর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরার চাপ বাড়ছে।
কিন্তু পূর্ব সতর্কতামূলক সব বিধিনিষেধ শিথিলে ভাইরাস বিস্তারের সুযোগ আরও বাড়বে এবং মহামারি দীর্ঘায়িত হবে বলে সতর্ক করেছে ডব্লিউএইচও।
এ অবস্থায় সংক্রমণের গতি রোধে টিকা কার্যক্রমের গতি বাড়াতে বিভিন্ন দেশের ওপর চাপ বাড়ছে।
করোনার সংক্রমণে শীর্ষ দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৫ শতাংশ, প্রায় ১৬ কোটি আমেরিকান দুই ডোজ টিকা গ্রহণ সম্পন্ন করেছেন।ভারতে এ হার মাত্র সাড়ে পাঁচ শতাংশ।
আপনার মতামত জানানঃ