করোনাভাইরাসের ডেল্টার প্রকোপে যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশই নাস্তানাবুদ, তখন মাসখানেকের মধ্যেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে চীন। যেন তারা আশ্চর্য চীনের প্রাচীর গড়ে রুখে দিয়েছে করোনাভাইরাসের এই প্রাণঘাতি ভ্যারিয়েন্টটি।
জুলাই মাসের পর গত সোমবার এই প্রথম একজন চীনা নাগরিকও কোভিডে সংক্রমিত হননি। রিপোর্টে এমনটাই জানিয়েছে সে দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন (এনএইচসি)। কিন্তু কীভাবে এত দ্রুত ডেল্টার সংক্রমণ রুখে দিল চীন?
সংক্রমিত করোনাভাইরাস রোগ সৃষ্টিকারী সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের বহুসংখ্যক জিনগত পরিবর্তিত ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে; যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আবির্ভূত হয়েছে। তবে যতগুলো সার্স-কোভি-২ ভ্যারিয়েন্ট এ যাবৎ শনাক্ত হয়েছে, তার মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সব থেকে বিপজ্জনক। এ ভ্যারিয়েন্টটি ২০২০ সালের শেষভাগে ভারতে প্রথম শনাক্ত করা হয়।
ডেল্টার বর্ধিত সংক্রমণযোগ্যতা, অধিকতর কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা, বর্ধিত মরণশীলতা, ভাইরাস নিরোধক টিকা এবং ওষুধগুলোর বিরুদ্ধে ঝুঁকি প্রবণতা হ্রাস, দেহের ইমিউন সিস্টেম এড়ানোর ক্ষমতা বা টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সংক্রমিত করার ক্ষমতা ইত্যাদি কারণে এই ভ্যারিয়েন্টটি ভয়াবহ তাণ্ডব চালাচ্ছে গোটা বিশ্বজুড়ে।
তবে কঠোর লকডাউন, বৃহৎ পরিসরে কোভিড পরীক্ষা ও দ্রুত শনাক্তদের চিহ্নিত করা, যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেই ডেল্টার ডানা ভেঙে দিয়েছে চীন। গোটা বিশ্ব ব্যর্থ হলেও, চীন জয় করে দেখিয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে; অজেয় নয় করোনার এই ধরনটি।
সূত্র মতে, ডেল্টা সংক্রমণ ছড়ানো মাত্রই নজরে থাকা বিভিন্ন প্রদেশে ছোট ছোট কন্টেনমেন্ট জোন তৈরি করে প্রায় ১ কোটি মানুষ লকডাউন বিধির আওতায় নিয়ে আসা হয়। তারপরই শুরু হয় কোভিড পরীক্ষা এবং সংক্রমিতদের চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া। সেই সঙ্গে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা। আর তাতেই বুমেরাং। এই চলতি মাসের শেষ সপ্তাহেই দেশকে ‘কোভিড-শূন্য’ ঘোষণা করল চীনের স্বাস্থ্য কমিশন।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ভারতে, তার পর ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। অতি-সংক্রামক এই ভ্যারিয়েন্টের হানাতেই ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। পরবর্তী কালে আমেরিকাতেও ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
গত জুলাইয়ে নানজিং প্রদেশ থেকেই করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে এমনটা আশঙ্কা চীনের কর্তৃপক্ষের। সেখানকার বিমানবন্দরে রাশিয়া থেকে আসা আন্তর্জাতিক বিমান পরিষ্কারের পর করোনায় আক্রান্ত হন এক ব্যক্তি। এরপরই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে ডেল্টা। এর মধ্যে ১৫ টি প্রদেশে সংক্রমণে খবর পাওয়া যায়। ফলে নানজিং প্রদেশের ৯২ লাখ মানুষকে করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রদেশটিকে লকাডাউন করা হয়।
২০২০ সালের পর গত জুলাই মাসেই প্রথম বার চীনে স্থানীয় সংক্রমণ ১,২০০ ছাড়িয়েছিল। ৩১টি প্রদেশের মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রদেশে মিলেছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা। পূর্ব প্রান্তের নানজিং শহরের বিমানবন্দরে একাধিক সাফাইকর্মীর শরীরে ডেল্টার উপস্থিতি প্রকাশ্যে আসতেই বিষয়টি নিয়ে তৎক্ষণাৎ উদ্বেগ প্রকাশ করে আঞ্চলিক স্তরে কড়া লকডাউন নীতি প্রয়োগ করে চীনা সরকার। এর পর ডেল্টার হানা বাড়তেই কঠোর হাতে তার মোকাবিলা করে প্রশাসন। যারই ফল মিলল।
বিশ্বের মধ্যে করোনা মোকাবিলায় যে সব দেশ সক্ষম হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম সারিতেই রয়েছে চীন। তালিকায় রয়েছে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড। তবে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরেও বহু সংক্রমিতের শরীরে ডেল্টার হদিশ পাওয়ায় তা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে সে দেশের বিশেষজ্ঞ মহলে।
অস্ট্রেলিয়াতেও কড়া লকডাউনবিধি জারি রয়েছে ডেল্টার মোকাবিলায়। দেশ ‘কোভিড-শূন্য’ হলেও চীনের সাধারণ নাগরিকদের উদ্দেশে সরকারের তরফে সতর্ক বার্তা জারি করে জানানো হয়েছে, অতিমারি-পর্ব এখনও শেষ হয়নি।
এছাড়া লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে নিউজিল্যান্ডও। করোনাভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এবং অকল্যান্ড থেকে রাজধানী ওয়েলিংটন পর্যন্ত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে তারা এ মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দিলো।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ