করোনা মহামারির শুরু থেকেই টিকা আর ‘হার্ড ইমিউনিটি’ নিয়ে আলাপ হয়েছে বিস্তর। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দিতে লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে সারা পৃথিবী। থমকে গেছে অর্থনীতির চাকা। দরিদ্র হয়েছে মানুষ; তবু প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া থেকে ঠেকাতে পারেনি।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি যখন শুরু হয়, তখন অনেক দেশেই হার্ড ইমিউনিটির ব্যাপারে কথাবার্তা হয়েছে। একটি বড় গোষ্ঠীর মধ্যে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেলেই রুখে দেওয়া যাবে করোনা মহামারি, এতদিন এটাই বিশ্বাস ছিল মানুষের। এমনকি বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকরাও অনেকটা এই সুরেই কথা বলতেন।
হার্ড ইমিউনিটি মূলত কী? ইংরেজি হার্ড শব্দটি এসেছে ভেড়ার পাল থেকে। আর ইমিউনিটি হচ্ছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। জানা যায়, ভেড়ার পালকে সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে টিকা দেয়া হতো। একশটি ভেড়ার মধ্যে যদি ৮০টিকে টিকা দেয়া হতো তাহলে সংক্রমণ আর ওই ভেড়ার পালে ছড়াতো না। যদিও একশটির প্রত্যেকটিকে টিকা দেয়া হয়নি, তারপরও তাদের মধ্যে এক ধরণের সুরক্ষা বলয় কাজ করতো। এটাই হচ্ছে হার্ড ইমিউনিটি। মানুষের ক্ষেত্রে বলা যায়, যখন একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে যদি নির্দিষ্ট অনুপাতে টিকা দেয়া যায়, তাহলে ওই কমিউনিটিতে আর সংক্রমণ হয়না। একে বলে হার্ড ইমিউনিটি।
কিন্তু সম্প্রতি একাংশের বিজ্ঞানীদের ভিন্ন দাবিতে নতুন করে আশঙ্কা ছড়াচ্ছে করোনা-সঙ্কট থেকে পাকাপাকি মুক্তির বিষয়টি নিয়ে। বিজ্ঞানীদের দাবি, পুরো গোষ্ঠী সংক্রমিত হয়ে গেলেও এই করোনা মহামারি থামবে না। করোনার ডেল্টা স্ট্রেনের সংক্রমণ ক্ষমতা দেখেই আসলে এরকম বলছেন তারা।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিকস’-এর অন্তর্গত টিকা গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পোলার্ড বলেন, ‘‘কোভিড ছড়ানো রুখতে ব্যর্থ টিকা। এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। হার্ড ইমিউনিটির বিষয়টিও এখন ‘কাল্পনিক তত্ত্ব’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
তিনি একটি আলোচনা সভায় বলেন, ‘‘আসলে সমস্যা হচ্ছে, এই ভাইরাসটি হাম নয়। কোনও জনগোষ্ঠীর ৯৫ শতাংশ বাসিন্দাকে যদি হামের টিকা দেওয়া হয়, ভাইরাস আর ছড়াতে পারবে না। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট কিন্তু এর পরেও ছড়াবে। যারা টিকা পেয়েছে, তাদের শরীরেও ছড়াবে। তার মানে কী! একে থামানোর কোনও পথ নেই!’’
কিছু দিন আগেই অবশ্য ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের একটি গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ১৮ থেকে ৬৪ বয়সসীমায় যাদের টিকা নেওয়া হয়ে গিয়েছে, তাদের সংক্রমিত হওয়ার ভয় অনেক কম। তুলনায় যারা টিকা নেননি, তাদের করোনা-আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
যে কারণে পৃথিবীর সব দেশে টিকাকরণে জোর দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ এ-ও বলছেন, যদি সংক্রমিতও হন, টিকা নেওয়া থাকলে বাড়াবাড়ি হবে না। হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না।
মূলত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টই চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের সমস্ত প্রেডিকশন পাল্টে দিচ্ছে। দুই ডোজ টিকা নেয়ার পরেও ডেল্টার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না এমন ঘটনা অহরহ। সবগুলো টিকা ৮০ শতাংশের উপরে সুরক্ষা দেবার দাবি জানালেও টিকা নেবার পরে ডেল্টায় সংক্রমিত হচ্ছে মানুষ।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় করোনাভাইরাসের টিকার উভয় ডোজ সম্পূর্ণ করার পরও ৪০ হাজারের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা একবার সংক্রমিত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং টিকা নেওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো করোনা সংক্রমিত হয়েছেন। দেশটির স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কেরালায় টিকা নেওয়ার পর যে ৪০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই রাজ্যের পাঠানামথিট্টা জেলার। এই জেলায় টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৯৭৪ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৪২ জন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এ পর্যন্ত কালের সবচেয়ে শক্তিশালী করোনাভাইরাস। দুই ডোজ টিকা নেওয়া থাকলেও করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণ হতে পারে শরীরে।
এদিকে, পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের সম্প্রতি প্রকাশ করা এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত মোট ৩ হাজার ৬৯২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ টিকা না নেওয়া মানুষ; আর ২২ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন।
সিঙ্গাপুরেও ছড়িয়েছে ডেল্টা ধরন। সেখানকার সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, সেখানে এই ভাইরাসে আক্রান্তদের তিন-চতুর্থাংশই টিকা নেওয়া মানুষ। যদিও তাদের কেউই গুরুতর অসুস্থ হননি।
করোনাভাইরাসের দুই ডোজ টিকা নেয়ার পর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। দুই ডোজ টিকা নেয়ার পর রোগীরা ভাইরাসে কতোটা ভুগছেন। কি সমস্যা হচ্ছে এসব বিষয়ে এখনো কোনো গবেষণা তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিশদ গবেষণা পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২০০৮
আপনার মতামত জানানঃ