কবরে লাশ আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে কয়েক দিন ধরে কবরস্থানে ছুটছেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মৃত ব্যক্তির স্বজনরা। ময়মনসিংহ শহরের একটি বাসা থেকে কঙ্কাল প্রাপ্তির খবর শোনার পর থেকে শুরু হয়েছে কবর খুঁড়ে লাশের অস্তিত্ত্ব নিশ্চিত হওয়ার এই হিড়িক। তারা কবর খুঁড়ে দেখছেন প্রিয়জনের লাশ আছে কিনা। অনেকেই জানিয়েছেন, কবরে তাদের প্রিয়জনদের লাশ নেই। এর আগেও জেলার মুক্তাগাছা ও ভালুকা থেকে বিপুল পরিমাণ পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল ও কঙ্কালের অংশবিশেষ উদ্ধার করেছিল পুলিশ।
ভাংনামারি ইউনিয়নের লোকজন জানান, এর আগে ২০১৮ সালের মার্চ মাসেও একবার শোনা গিয়েছিল যে, কবর থেকে লাশ চুরি হয়ে যাচ্ছে। তখনও খবর পেয়ে তারা কবরস্থানে ছুটে যান। দেখা যায়, মাত্র দুই-আড়াই ফুট ফাঁক করে অভিনব পদ্ধতিতে একের পর এক কবরের কঙ্কাল চুরি হয়ে গেছে। বিষয়টি থানায় জানিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি। এরপর অপরাধী চক্রের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েছে। তবে তারা আরও কৌশলী হয়েছে বিধায় ইদানীং আর কবর দেখে খালি চোখে কিছুই টের পাওয়া যাচ্ছে না।
১৪ নভেম্বর ২০২০, শনিবার রাতে ময়মনসিংহের আরকে মিশন রোডের একটি বাসা থেকে ১২টি কঙ্কাল ও দুই বস্তা হাড় উদ্ধার হয়। এরপর ভাংনামারিতে আবার হইচই শুরু হয়ে যায়। লাশ চুরির ঘটনা শুনে ভাংনামারী ইউনিয়নের হাজী আবদুল মজিদের ছেলে আবুল হাসাদ বাচ্চু ছুটে যান মায়ের কবরে। কবরের মাথার অংশে দুই-আড়াই ফুট ফাঁকা দেখে চমকে ওঠেন। গ্রামবাসীকে নিয়ে মাটি সরিয়ে দেখেন ‘কঙ্কাল’ নেই। স্ত্রীর কঙ্কাল নেই এ কথা শুনেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন হাজী আবদুল মজিদ। বাচ্চু জানান, তার মা নূরজাহান বেগম প্রায় দেড় বছর আগে মারা যান। মা হারানোর শোক এখনও কাটাতে পারেননি। এখন দেখছেন কবরে মায়ের কঙ্কাল নেই।
কুলিয়ারচর গ্রামের মৃত রুস্তম আলীর স্ত্রী হাসনা আক্তারের কবর খুঁড়ে কঙ্কাল পাওয়া যায়নি। তিনি মারা যান প্রায় ২ বছর আগে। ৩ বছর আগে মারা যান মোর্শেদ আলী। কবরে তার কঙ্কালও নেই। গজারিয়া গ্রামের আবদুর রাজ্জাক জানান, কবরে তার ভাই আবু চান ও সালেহা খাতুনের কঙ্কাল নেই। কবরে জুবেদা খাতুন নামে একজনের কঙ্কালও নেই।
তার ছেলে আবদুল খালেক জানান, ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরেও মায়ের কবর মেরামত করেছি। কবর ভেঙে গেছে দেখে মেরামত করেছি। কঙ্কাল নেই, সেটা আগে বুঝতে পারিনি। গ্রামের লোকজন কবর খোঁড়াখুঁড়ি শেষে নিশ্চিত করেন ২১টি কবরে কঙ্কাল নেই। এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। লাশ চুরি করে তা বিক্রি করে ব্যবসা হয় এটা আগে জানা ছিল না। এটা ভয়ানক একটি বিষয়। এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
ভাংনামারী ইউনিয়নের আবুল হাসনাত বাচ্চু বলেন, ঘটনার পরপরই আমরা থাকায় অভিযোগ দায়ের করি। পুলিশ অভিযোগ নিয়েও চিহ্নিত চোরদের গ্রেফতারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। দীর্ঘদিন পরও স্বজনদের কঙ্কাল সন্ধান পাইনি। মানবাধিকার কমিশন গৌরীপুর উপজেলার সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ বলেন, চুরির বিষয়টি পুলিশ জানানোর পরও ব্যবস্থা না নেয়া দুঃখজনক।
স্থানীয় গণ্যমান্যরা মনে করছেন, মানুষের অভাব বেড়ে গেছে। এ কারণেই হয়তো নতুন করে তারা আবার কবর থেকে লাশ চুরিতে নেমেছে। তবে অনেকের ধারণা সঙ্ঘবদ্ধ কোন চক্র স্থানীয় অপরাধীদের কাজে লাগিয়ে এসব ঘটাচ্ছে। মানবাধিকারকর্মী ফয়সাল ইসলাম জানান, করব থেকে কঙ্কাল চুরির ঘটনায় আমরা বিস্মিত। মনে হয়, বিশেষ ধরনের কোনো যন্ত্র দিয়ে পুরো কঙ্কাল সহজেই চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে চক্রটি।
যেভাবে লাশ চুরির খবর ফাঁস : ২০১৮ সালের মার্চ মাসে চুরি হওয়া কঙ্কাল বিক্রির টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আকির হোসেন, রাসেল মিয়া আর হযরত আলী নামে তিনজনের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। এই বিবাদের জেরেই চুরির ঘটনা ফাঁস হয়। ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিবাদের বিষয়টি শুনতে পান ভাংনামারী ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে নয়ন মিয়া।
এ চক্রের ৩ জনের বাড়িই তার এলাকায়। বিষয়টি তিনি তার ভাই ফয়সাল ইসলামকে ফোনে জানান। তার দাদা ওয়াহেদ আলী ও দাদি কদর বানুর কবরে কঙ্কাল আছে কিনা জানতে চান? পরিবারের লোকজন ছুটে গিয়ে দেখেন, দুটি কবরেই দুই-আড়াই ফুট করে গর্ত (ফাঁকা)। কবরে কঙ্কাল নেই! এরপর ছুটে আসেন আত্মীয়স্বজনরা।
তাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ ছুটে আসে এবং নগরীর আর কে মিশন রোডের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ১২টি মাথার খুলি ও দুই বস্তা মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের হাড় উদ্ধার করে। এ সময় দুই কন্টেইনার তরল ক্যামিকেল ও তিন প্যাকেট গুড়া কেমিক্যালসহ বাপ্পি (২৫) নামের এক যুবককে আটক করা হয়। সে নগরীর কালিবাড়ী কবরস্থান এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে।
মামলার অগ্রগতি : আটক বাপ্পির কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে কোতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার। তিনি জানান, প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল ২০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা দামে পার্শ্ববর্তী হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
পুলিশ জানায়, কঙ্কাল চুরি চক্রের সঙ্গে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কিছু মাদকাসক্তদের পাশাপাশি বিভিন্ন গোরস্থানের কবর খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জড়িত বলে তারা প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছে। চক্রের সদস্যরা সামান্য টাকায় কবর থেকে মরদেহ চুরি করিয়ে সেই ওইসব স্থানে নিয়ে কেমিক্যাল বা দ্রুত পচনে সাহায্যকারী পদার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত সম্পন্ন করে কঙ্কাল পাচারকারি হাতে তুলে দেয়।
কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, গোরস্থানের গোরখোদকদের সঙ্গে জড়িতদের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তির খবর চলে যায় তাদের কাছে। প্রথমে কবর থেকে মরদেহ তুলে কেমিক্যাল ব্যবহারের মাধ্যমে পঁচানো হয়। পরে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল সংগ্রহ করে তারা। পরে তা তুলে দেওয়া হয় বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা পাচারকারির হাতে। তাদের মাধ্যমে এই কঙ্কাল চলে যায় মেডিকেল শিক্ষার্থী-শিক্ষক, চিকিৎসকসহ পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল ও ভারতে।
তিনি জানান, কালিবাড়ী গোরস্থানের কবর খুঁড়াখুঁড়ির কাজে সংশ্লিষ্ট চান মিয়াও এই চোর চক্রের সঙ্গে জড়িত। তাকে জিঞ্জাসাবাদ করা হবে। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট সাতজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে ২০১৮ সালের ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে পুলিশে অবহেলার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আগের খবর তো আমার জানা নেই।
মিই/আরা/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ