মুঘল আমলের স্থাপনা লালবাগ কেল্লা পুরনো ঢাকায় অবস্থিত। বাংলা ও বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসের অনেক কিছুকেই ধারণ করছে এই প্রাচীন ও জননন্দিত স্থাপনা। তবে কালের আঘাতে এব সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা না থাকায় এই স্থাপনার অনেক কিছু ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে। ভবনগুলো জরাজীর্ণ। প্রয়োজন আমূল সংস্কার। এতদিন পড়ে থাকলেও এখন সেই সংস্কার কাজ শুরু হতে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে। অর্থায়নের উৎসদেশ যুক্তরাষ্ট্র হওয়ায় বিষয়টি পুরান ঢাকার মানুষদের নজর কেড়েছে। চলছে নানা আলোচনা।
বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে মানুষের উদ্বেগ-আপত্তির শেষ নেই। মুসলিমপ্রধান সমাজ হওয়ায় ইরাক আক্রমণ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা একেবারেই তলানিতে। এ অবস্থায় মুসলিম স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত একটি প্রাচীন স্থাপনা সংস্কারের জন্য মার্কিন অনুদান অনেকের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। এলাকাবাসীও জেনে গেছে এ কথা। দর্শনার্থী বা পর্যটকদের দেখলেই তারা বলছেন, অখন যেমন দেখতাছেন এমন কিন্তু আর পাইবেন না। আমেরিকার ডলার আইতাচে। লালবাগ কেল্লা সারাই অইব!
জানা গেছে, অনুদানের অর্থের পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা। এ টাকায় ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লার দরবার হল ও হাম্মামখানা সংস্কার করা হবে। শিগগিরই এ কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে। সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে লালবাগ কেল্লার ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাটির খসে পড়া দেয়ালের নানা অংশ, ছাদের অংশ, ফেটে যাওয়া মেঝে, ক্ষতিগ্রস্ত হাম্মামখানার কিছু অংশ, কাঠের জানালাসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার কাজ করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে হাম্মামখানার দ্বিতীয় তলা বর্তমানে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ রয়েছে। সংস্কার কাজ সম্পন্ন হলে সেটি সবার জন্য খুলে দেয়া হতে পারে বলেও আশা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক হান্নান মিয়া বলেন, লালবাগ কেল্লার দরবার হল ও হাম্মামখানার সংস্কারের জন্য আমরা ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসের সংস্কৃতি ফান্ড থেকে অনুদান পেয়েছি। সে অনুদানটি প্রায় দেড় কোটি টাকার। আগামী সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে আমরা পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ সংক্রান্ত নিয়োগগুলো সম্পন্ন করব। তবে হাতে-কলমে কাজ শুরু হবে আগামী বছরের জানুয়ারিতে। তিনি জানান, কেল্লা সংস্কার হবে জেনে স্থানীয়রা খুবই আনন্দিত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
লালবাগ কেল্লার দরবার হল ও হাম্মামখানার বর্তমান পরিস্থিতি জানতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আসলেই বেশকিছু সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। এর দ্বিতল ভবনের নিচতলায় হাম্মামখানার অবস্থান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পুরো নিচতলার বিভিন্ন অংশের দেয়ালের আস্তরণ ক্ষতিগ্রস্ত। অনেক জায়গায় রং উঠে গেছে। লাল অংশ ফুটে উঠেছে। হাম্মামখানার ভেতরে মেঝের কয়েকটি অংশে ফাটল রয়েছে। এমনকি গোসলের যে স্থানটি রয়েছে সেখানেও অনেক আস্তরণ উঠে গেছে। ওপাশে কাঠের যে জানালাগুলো রয়েছে সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। পাশাপাশি বর্তমানে এখানে বৈদ্যুতিক তারগুলো দেয়ালের বাহির থেকে সন্নিবেশিত করা। এগুলোও পর্যায়ক্রমে ঠিক করা হবে বলে জানা গেছে।
কয়েক বছর আগে বুয়েটের একটি দল দ্বিতীয়তলাটি পরীক্ষা করে এটি ঝঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলে জানা যায়। তার পর থেকেই এখানে সাধারণের প্রবেশ বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তবে বর্তমান সংস্কার কাজের অংশ হিসেবে দ্বিতীয়তলার কাজও করা হবে বলে জানা যায়। দ্বিতীয়তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মেঝের অনেক অংশেই ফাটল রয়েছে। অনেক দেয়ালের আস্তরণ খসে গেছে। পাশাপাশি সিলিংয়ের অংশ চুয়ে পানি পড়ে দেখা যায়। সংস্কার হবে ওপরে ছাদের অংশেও। কেল্লার ভেতর পরী বিবির সমাধির অংশে বেশকিছু অংশে পাথরের জালি রয়েছে যেগুলো দিয়ে আলো-বাতাস চলাচল করে। একই ধরনের লোহার জালি থাকার কথা দরবার হল ও হাম্মামখানার অংশেও। কিন্তু সেখানে আগে যে সংস্কার কাজ করা হয়েছিল তাতে শুধু পরী বিবির সমাধির আদলে কাজ রয়েছে যা সিমেন্টের। সেখানে আলো-বাতাস প্রবেশেরও কোনো সুযোগ নেই।
স্থানীয়রা অবশ্য সংস্কারের পদ্ধতির চেয়ে অনুদানের অর্থের উৎস নিয়ে বেশি আগ্রহী। কলেজ শিক্ষার্থী ইরফান হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ অনেক ক্ষেত্রেই যে এগিয়ে আছে, এটা এলাকার লোকজন বলছেন। তারা অমুসলিম হয়েও লালবাগ কেল্লার মতো মসজিদে টাকা দিয়েছেন, এতে সবাই অবাক হয়েছে এবং প্রশংসাও করেছে। তবে টাকার যা অঙ্ক, তাতে এমন মন্তব্যও এসেছে যে, সরকার চাইলে এই টাকা নস্যি। এখানে বিদেশি সাহায্যের দরকার ছিল না।
মিই/আরা/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ