ধর্মবাদী রাজনীতি প্রতিনিয়ত নতুন ইস্যু খোঁজে। দক্ষিণ এশিয়া তার ভালো সাক্ষী। এ রকম খোঁজাখুঁজি মাত্রই বিষাক্ত করে তোলে ঐতিহাসিক আন্তধর্মীয় সম্পর্ক। তাতে ধর্মে-ধর্মে বিভেদ ও বিবাদ বাড়ে। নাগরিক স্বাধীনতার পরিসরও ক্রমে ছোট হয়।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে এ বিভেদবাদ নতুন হট্টগোল তুলেছে। এবারের বিষয় আন্তধর্মীয় বিয়ে। ধর্মকে বিশুদ্ধ রাখতে হবে। শুমারিতে ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাও কমতে দেওয়া যাবে না। তাই এ রকম বিয়ের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ ভারতীয়। খবর বিবিসির
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপকেন্দ্রিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য।
উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে দুই ধর্মের মানুষের বিয়েকে অপরাধ বিবেচনায় আইন কার্যকরের পর হলো এ গবেষণা।
বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ভারতীয়রা জরিপে বলেছেন যে দুই ধর্মের নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণার জন্য ভারতজুড়ে ২৬টি রাজ্য ও তিনটি কেন্দ্র সরকারশাসিত অঞ্চলের ১৭টি ভাষাভাষী ৩০ হাজার মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে পিউ।
জরিপে অংশ নেয়া ইসলামের অনুসারীদের ৮০ শতাংশ জানান, তাদের ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে দেখতে চান না তারা। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একই মত দিয়েছেন ৬৫ শতাংশ মানুষ।
জরিপে ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন জাতীয়তা বা নাগরিকত্বের মানুষের মধ্যে বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। দেখা গেছে, বেশির ভাগ হিন্দু ধর্মীয় পরিচয় ও জাতীয় পরিচয়কে এক বলে মনে করেন।
জরিপে অংশ নেয়া হিন্দুদের ৬৪ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই মনে করেন, ‘প্রকৃত ভারতীয়’ হতে হলে হিন্দু হওয়া খুব জরুরি।
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ধর্মবিশ্বাস আর মূল্যবোধে কিছু মিল থাকলেও তা অনুভব করেন না তারা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারতীয়দের সবাই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা চর্চার বিষয়ে বেশ উৎসাহী। কিন্তু আবার ধর্মীয় সম্প্রদায়ই নিজেদের অগ্রাধিকার দিয়ে পৃথক জীবনচর্চায় অভ্যস্ত। একসঙ্গে থেকেও বিচ্ছিন্ন তারা।’
বন্ধু হলেও ধর্মীয়ভাবে পৃথক জীবনযাপন করেন অনেক মানুষ। অন্য ধর্মের মানুষকে নিজেদের এলাকা বা গ্রামে থাকতে দিতেও রাজি নন তারা।
রক্ষণশীল ভারতীয় পরিবারগুলোতে হিন্দু-মুসলিম বিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার বিষয়। কিন্তু এখন হিন্দু-মুসলিম দম্পতিরা আইনিভাবেও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন ভারতে।
ভারতে বিশেষ বিবাহ আইনের সংশোধনীতে দুই ধর্মের মানুষের বিয়ের ৩০ দিন আগে প্রশাসনকে অবহিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের আমলে ভারতের কিছু রাজ্য এ বিষয়ে আরও এক ধাপ আগে। দুই ধর্মের মানুষের বিয়েকে ‘জোরপূর্বক বা প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধভাবে ধর্মান্তরিত করা’ বিবেচনায় আইনিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে রাজ্যগুলোতে।
হিন্দু মেয়ে ও মুসলমান ছেলের বিয়েকেই ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ‘লাভ জিহাদ’ বলছেন। তাদের ব্যাখ্যায়, হিন্দু নারীদের ধর্মান্তর ঘটানোই এর একমাত্র উদ্দেশ্য। সে ক্ষেত্রে প্রেমকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের চোখে হিন্দু ছেলে ও মুসলমান মেয়ের বিয়েতে অবশ্য আপত্তির কিছু নেই।
উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকার বিয়ের উদ্দেশ্যে ধর্মান্তর রুখতে গত ২৪ নভেম্বর অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারি করে। বিয়ের উদ্দেশ্যে জবরদস্তি অথবা ছলচাতুরীর মাধ্যমে হিন্দু মেয়ের ধর্মান্তর করানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে ক্ষেত্রবিশেষে ১০ বছরের সাজা হবে।
বিজেপির এই উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা করছেন বিরোধীরা। রাজস্থানের কংগ্রেসদলীয় মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি দিয়ে সম্প্রীতি নষ্ট করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মেরুকরণই বিজেপির উদ্দেশ্য। জেলা প্রশাসকের অনুমতি পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ধারণা, বহু ক্ষেত্রে বিজেপিশাসিত রাজ্যের জেলা প্রশাসকেরা এই প্রবণতা রুখতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভেদবাদ যে সম্প্রীতির পরিসর কমাতে চাইবে, সেটা নতুন নয়। আন্তধর্মীয় বিয়ে হয় সাধারণত প্রেম ও ভালোবাসার ফল হিসেবে। নগরায়ণ, উচ্চশিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যৌথ অংশগ্রহণ যত বাড়ছে, এ রকম বিয়ের ঘটনাও বিশ্বজুড়ে তত বাড়ছে। এটা যেকোনো সমাজে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতিরও নিদর্শন।
তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে শত শত বছর ধরে এ রকম বিয়ের নজির আছে। বলিউডের বিখ্যাত দম্পতিরা অনেকে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের। উপমহাদেশের সমাজের স্বাভাবিক সামাজিক শক্তির জায়গা ছিল এসব। তবে এ রকম সমাজে ধর্মে-ধর্মে কাজিয়া লাগানো কঠিন। সেই বিবেচনা থেকেই হয়তো এ রকম বিয়ের বিরোধিতার ইতিহাসও বেশ পুরোনো।
বিরুদ্ধবাদীরা আন্তধর্মীয় বিয়েকে বলছে ভালোবাসার নামে একধরনের জিহাদি কার্যক্রম। ধর্মীয় আবরণ দিয়ে একে বলা হচ্ছে ‘লাভ জিহাদ’। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বিশেষ এক ধর্মকে ইঙ্গিত করেই এ রকম নামকরণ।
আন্তধর্মীয় বিয়ে নিয়ে সরাসরি রাজনীতি না হলেও সামাজিক টানাপোড়েন আছে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশে। আপাতত এটা আরএসএস শিবিরের বড় এক রাজনীতি হয়ে উঠলেও নীরবে এ রকম বিয়ের বিরোধিতা আছে অন্যান্য ধর্মেও। বিরোধিতাকে ন্যায্যতা দিতেই এ রকম প্রেমের বিয়েকে ধর্মবিরোধী ষড়যন্ত্রের আবরণও দেওয়া হয়। বলা হয়, এসব বিয়ে মানেই কোনো এক ধর্মের জনসংখ্যা কমানোর অপচেষ্টা!
সচরাচর আন্তধর্মীয় বিয়ে বিরোধীদের মূল টার্গেট নিজ নিজ ধর্মের নারীরা। ভয় ছড়ানো হয়, কোনো ধর্মে নারীরা এভাবে বিয়ে করতে থাকলে লোকগণনায় ওই ধর্মের হিস্যা কমে যাবে। সংখ্যায় কমা মানেই শুমারিতে নিচে পড়ে যাওয়া। আর ভোটের অঙ্কে হেরে যাওয়ার শঙ্কা।
এ রকম ভীতি ছড়িয়েই পুরো ধর্মের অভিভাবক হিসেবে নিজেদের জাহির করে আন্তধর্মীয় প্রেম ও বিয়ের বিরুদ্ধবাদীরা। এ রকম বিয়ে রোখা তাদের কাছে ‘নিজেদের ভগ্নী ও কন্যাদের সম্মান’ রক্ষার চেষ্টাতুল্য। স্বঘোষিতভাবে তারা নারীর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।
বাস্তবে এটা নতুন মোড়কে পুরোদস্তুর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। ভারতে এমনও আতঙ্ক তোলা হয়েছে, আন্তধর্মীয় বিয়ে চলতে থাকলে ‘জনগণকে স্থায়ীভাবে মুসলমান প্রধানমন্ত্রী দেখতে হবে’। এসব ভীতি বেশ ভালো কাজে দিচ্ছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানবিক বিকাশের সুযোগ না পাওয়া মানুষ অনেক সময় এ রকম ভীতিতে প্রভাবিত হতে শুরু করে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে কেউ চায় না নিজ ধর্মের মানুষের সংখ্যা কমে যাক।
একই রকম ভীতি ছড়ানো হতো আগে ‘ধর্মান্তকরণ’-এর কথা বলে। এ তত্ত্বের জেরেই এসব আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করেছে হিন্দুত্ববাদী রাজ্য সরকারগুলো।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৯
আপনার মতামত জানানঃ