সবেমাত্র কমতে শুরু করেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ। ভারতে দৈনিক সংক্রমণ ৫০ হাজারের ধারেকাছে চলে এসেছে। তারই মধ্যে তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করল কেন্দ্রীয় সরকার। ভয়ের কথা, তৃতীয় ঢেউয়ে ডেল্টা প্লাস সংস্করণের করোনা সংক্রমিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাধারণ করোনার চেয়ে যা অনেক বেশি শক্তিশালী। ভারত সরকার তিনটি রাজ্যকে সতর্কতামূলক চিঠি পাঠিয়েছে এ বিষয়ে।
কয়েকটি গবেষণার তথ্য উদ্ধৃত করে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তথাকথিত ‘ডেল্টা প্লাস’ ভ্যারিয়ান্ট আগের ভ্যারিয়ান্টগুলোর চেয়ে সহজে ছড়ায়, ফুসফুসের কোষের সাথে অপেক্ষাকৃত সহজে যুক্ত হয় এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবহৃত টিকা যে মূলনীতি অনুসারে তৈরি করা হয় – ‘মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপি’ – তার বিরুদ্ধে কার্যকর।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ভারতে প্রথমবার ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়ান্ট পাওয়া যায় এ বছরের এপ্রিল মাসে। তিনটি অঙ্গরাজ্যের ৬টি জেলায় এই ভ্যারিয়ান্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
ভারত ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন সহ ৯টি দেশে এই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়ান্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট এরই মধ্যে বিশ্বের ৮০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভাইরাস সাধারণত সবসময়ই পরিবর্তিত হতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাস পরিবর্তিত হয়ে দুর্বল হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবর্তিত ভাইরাস পুরনো ভাইরাসের চেয়ে শক্তিশালী ও বেশি সংক্রামক হয়ে দেখা দেয়, যেই পরিবর্তিত রূপটি অন্য ভ্যারিয়ান্টগুলোর তুলনায় বেশি মারাত্মক অসুস্থতা তৈরি করে।
ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়ান্টটিতে ‘কে৪১৭এন’ নামে একটি অতিরিক্ত মিউটেশন রয়েছে, যেটি দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে শনাক্ত হওয়া বেটা ও গামা ভ্যারিয়ান্টেও পাওয়া গেছে।
২২জন রোগী পাওয়া গেছে
ভারতে এখনো পর্যন্ত এই ভেরিয়েন্টের ২২জন রোগী পাওয়া গেছে। বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা চলছে। ডেল্টা প্লাস ভেরিয়েন্ট সম্পর্কে এখনো খুব বেশি তথ্য নেই ভাইরোলজিস্টদের কাছে। তবে যে ২২ জনের দেহে ডেল্টা প্লাসের নমুনা মিলেছে, তাদের জিনোম সিকোয়েন্স করে নতুন সংস্করণের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মহারাষ্ট্রের রত্নগিরির জলগাঁও, কেরালার পলক্কড় এবং মধ্যপ্রদেশের ভোপাল ও শিবপুরীতে নতুন সংস্করণে আক্রান্ত রোগীর হদিশ মিলেছে। তারপরেই কেন্দ্র তিনটি রাজ্যকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে। তৃতীয় ঢেউ নিয়েও সতর্ক করা হয়েছে।
এইমস-এর প্রধান রণদীপ গুলেরিয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ একটু কমতেই মানুষ করোনা নিয়ম অগ্রাহ্য করতে শুরু করেছে। লকডাউনও শিথিল হতে শুরু করেছে। এভাবে চললে এক-দেড় মাসের মধ্যে তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে। নীতি আয়োগের সদস্য বিনোদ পল জানিয়েছেন, তৃতীয় ঢেউ নিয়ে সরকারকে আরো সতর্ক হতে হবে। গোড়াতেই এই স্ট্রেনের সংক্রমণ আটকাতে না পারলে সরকারকে প্রবল সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ, ডেল্টা স্ট্রেনের চেয়েও পাঁচ থেকে ছয়গুণ শক্তিশালী নতুন এই সংস্করণ। মৃত্যুর হারও বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
টিকা নেওয়া থাকলে কি ভয় নেই?
প্রশ্ন উঠছে, টিকা নেওয়া থাকলে কি এই স্ট্রেন থেকে বাঁচা সম্ভব? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য এখনো তাদের কাছে নেই। তবে সম্ভবত টিকার বাধাও মানবে না এই স্ট্রেন। তা সত্ত্বেও যে অঞ্চলগুলিতে ডেল্টা প্লাস স্ট্রেন ছড়িয়েছে, সেখানে দ্রুত টিকাকরণ সম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা করেছে সরকার।
হালকাভাবে নিতে চাননা বিশেষজ্ঞরা
অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়ান্টকে হালকাভাবে নেয়ার পক্ষপাতী নন। দিল্লির ইনস্টিটিউট অব জিনোমিকস অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলোজির পরিচালক ডা অনুরাগ আগারওয়ালের মতে, “ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট থেকে তৈরি হওয়া সব ভ্যারিয়ান্টই দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে।”
পূর্ববর্তী ভ্যারিয়ান্টে আক্রান্তদের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ করোনাভাইরাসের সাধারণ উপসর্গের পাশাপাশি আরো কিছু বিশেষ উপসর্গের উপস্থিতি থাকে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের সংক্রমণের ক্ষেত্রে।
বিশেজ্ঞরা বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টের অন্যতম প্রধান উপসর্গ মাথা ব্যাথা। এর পাশাপাশি গলা ব্যাথা, সর্দি এবং জ্বরও থাকতে পারে। তবে এই ভ্যারিয়ান্টে আক্রান্ত হলে স্বাদ বা গন্ধের অনুভূতি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। পাশাপাশি কাশি হওয়ার সম্ভাবনাও বেশ কম।
যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞদের হিসেব অনুযায়ী, পূর্ববর্তী ভ্যারিয়ান্টগুলোর চেয়ে ডেল্টা ভ্যারিয়ান্ট অন্তত ৬০% বেশি সংক্রামক। এছাড়া পূর্ববর্তী ভ্যারিয়ান্টে আক্রান্তদের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়ান্টে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ।
ভারতে করোনা শনাক্তের হার ২.৯১%
ভারতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৪ হাজার ৬৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ১ হাজার ৩২১ জন। আজ বৃহস্পতিবার এনডিটিভি অনলাইনের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
সবশেষ এ তথ্য নিয়ে ভারতে করোনায় সংক্রমিত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৮২ হাজার ৭৭৮। মারা যাওয়া মানুষের মোট সংখ্যা ৩ লাখ ৯১ হাজার ৯৮১। ভারতে টানা ১৭ দিন ধরে ৫ শতাংশের নিচে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। ভারতে এখন পর্যন্ত ৩০ কোটির বেশি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে গতকাল ৫৮ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এফএ/১৩৫৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ