ইয়াংৎসি অর্থাৎ ‘সমুদ্রের সন্তান’। পশ্চিমারা এই নামেই তিব্বতের তাংগুলা পর্বতমালার বরফগলা পানি থেকে জন্ম নেয়া এশিয়ার সবচেয়ে বড় নদীটিকে চেনে। চীনে যদিও একে ডাকা হয় ছাং চিয়াং নামে। যার অর্থ ‘বড় নদী’। এটি এশিয়ার সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী। নীলনদ এবং আমাজনই কেবল মাত্র ইয়াংৎসি থেকে দীর্ঘ। সাংহাই শহরের কাছে এসে ইয়াংৎসি পূর্ব চীন সাগরে মিলিত হয়েছে। এর আগে এ নদী পাড়ি দিয়েছে প্রায় ৬,৩০০ কিলোমিটার। পাড়ি দিয়েছে চীনের ১০ টি প্রদেশ। নদীটির মাঝামাঝি অংশে আছে তিন গিরিসঙ্কট। কিউট্যাং, উ এবং শিলিং শিয়া। এই শিলিং গিরিসঙ্কটেই নির্মাণ করা হয়েছে পৃথিবী কাঁপানো ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’ বা তিন গিরিসঙ্কটের বাঁধ।
এই বাঁধটির উচ্চতা ১৮৫ মিটার। অর্থাৎ প্রায় ৬০ তলা ভবনের সমান উঁচু এই বাঁধটি। প্রস্থ প্রায় ২ হাজার ৩০৯ মিটার। এটিই বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ। এই বাঁধের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২২,৫০০ মেগাওয়াট। মহাকাশ থেকে খালি চোখে দেখা যায়, এমন মানবসৃষ্ট স্থাপনাগুলোর মধ্যে ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’ একটি। মহাপ্রাচীরের পর এটিই চীনের সবচেয়ে বড় স্থাপনা। প্রায় দুই দশক ধরে নির্মাণ কাজ চালিয়ে, ২০০৮ সালে এ বাঁধের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ অব্দে হ্যান রাজবংশের শুরু থেকে ১৯১১ সালে চিং রাজবংশের পতন পর্যন্ত ইয়াংৎসি নদীর কারণে ২১৪ বার বন্যার রেকর্ড পাওয়া যায়। বন্যা প্রতিরোধে খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৫ থেকে বাঁধ নির্মিত হয়ে আসছে চীনে। বর্তমানে চীনে প্রায় ৮৭ হাজার বাঁধ আছে। যার মধ্যে বড় বাঁধের সংখ্যা ২৩ হাজারেরও বেশি। যা বিশ্বের মোট বাঁধের ৪১ শতাংশ।
১৯৪৯ সালে যখন চীনে মাও সে তুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির শাসন শুরুর আরও ৩০ বছর আগে থেকেই ইয়াংৎসিতে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিপ্লবী নেতা সান ইয়াৎ সেন। এর উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯১৯ সালে তার লেখা ‘অ্যা প্ল্যান টু ডেভেলপ ইন্ডাস্ট্রি’ নামের একটি নিবন্ধতে। তার বড় বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাবনার উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। এই বাঁধ নির্মানের জন্য চীন ও আমেরিকার মধ্যে একটা চুক্তিও হয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা ও গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ায় ১৯৪৭ সালে চিয়াং কাই-শেক সরকার এই প্রকল্প বাতিল করেন।
এরপর ১৯৫৪ সালের ইয়াংৎসি নদীর ভয়াবহ বন্যায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মারা গেলে, এই বাঁধ নিয়ে নড়েচড়ে বসেন মাও সে তুং। তবে ‘হান্ড্রেড ফ্লাওয়ার্স মুভমেন্ট’ তখন পানি ঢেলে দেয় এই প্রকল্পে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইচ্ছা থেকে আবারও ১৯৫৮ সালে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে ব্যক্তিগতভাবে ‘থ্রি গর্জেস প্রকল্প’ তদারকি করার নির্দেশ দেন মাও। এরপর ১৯৫৯ সালে বাঁধ নির্মাণের জন্য স্যানদুওপিং অঞ্চলকে উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। কিন্তু মাওয়ের গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড পরবর্তী দুর্ভিক্ষ ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে এই প্রকল্পও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নই।
এর প্রায় দুই দশক পর ১৯৭৯ সালে চীনের ক্ষমতায় আসেন দেং শিয়াওপিং। তিনিও এ প্রকল্পে জোর সমর্থন দেন। এরপর বহু সমালোচনা এবং গণহত্যার পর ১৯৯৩ সালে ‘থ্রি গর্জেস প্রকল্প’ নির্মাণ কমিটি এর প্রাথমিক নকশা অনুমোদন করে। এ নকশায় বাঁধের উচ্চতা রাখা হয় ১৮৫ মিটার। যাতে আবদ্ধ জলাধারের পানির উচ্চতা ছিল ১৭৫ মিটার। ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর, এ প্রকল্প নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
পুরো সময় জুড়ে পরিবেশের ওপর ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’-এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে সমালোচনা হয়েছে অনেক। এই বাঁধের জন্য একটি কৃত্রিম জলাধার তৈরি করা হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১.১২ কিলোমিটার। পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল প্রায় ১ হাজার ৪৫ কিলোমিটার। এ জলাধারের পানি ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৩৯.৩ ঘন কিলোমিটার। যার ভর ৩৯ ট্রিলিয়ন কিলোগ্রামেরও বেশি।
যদিও তা পৃথিবীর মোট ভরের তুলনায় অতি সামান্য, তবে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিতে প্রভাব রাখার জন্য যথেষ্ট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭৫ মিটার উচ্চতায় প্রায় ৩৯.৩ ঘন কিলোমিটার পানি ধরে রাখার ফলে এর প্রভাব গিয়ে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিতে পড়ছে। তৈরি হওয়া এই প্রভাবকে বলা হয় ‘মোমেন্ট অব ইনারশিয়া’। এত বেশি পরিমাণ পানি এই বাঁধে জমা করার জন্যই পৃথিবী তার ঘূর্ণন গতির কিছুটা ভরবেগ হারায়।
কোনও অক্ষের সাপেক্ষে ঘূর্ণনরত বস্তুর ঘূর্ণন গতিকে বাধা দেয়ার প্রয়াসকে জড়তার ভ্রামক বলা হয়। অক্ষ থেকে ঘূর্ণনরত বস্তুর দূরত্ব যত বেশি হয়, তার ঘূর্ণন গতিও তত কমে যায়। বাঁধের জলাধারের কারণে পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থান কিছুটা গোলাকার ও মেরু অঞ্চল কিছুটা সমতল হয়ে পড়বে। ফলে পৃথিবীর জড়তার ভ্রামক বেড়ে যাবে এবং কমে যাবে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি। যদিও এর পরিমাণ খুবই অল্প। নাসার গবেষকদের মতে, এতে পৃথিবীতে দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ০.০৬ মাইক্রোসেকেন্ড বেড়ে যাবে।
এই ‘থ্রি গর্জেস ড্যাম’ নিয়ে যেমন গর্ব আছে চীনের তেমন আছে বিতর্কও। বন্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে এ বাঁধ ভোগান্তিরও কারণ চীনের। ইয়াংৎসি নদীর তীরবর্তী প্রায় ১৪ লাখ লোককে তখন নিজেদের বাসস্থল থেকে সরে যেতে হয়েছিল। যাদের অধিকাংশই ছিল গরিব কৃষক ও জেলে। এই বাঁধ নির্মানের জন্য ১১৪টি শহর ও ১ হাজার ৬৮০টি গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য পর্যাপ্ত বাসস্থান বা ক্ষতিপূরণ দেয়নি চীন সরকার। বরং স্থানীয় সরকার তাদের জন্য আসা ফান্ড থেকে দুর্নীতি করেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। ২০১৩ সালে চীন সরকার দুর্নীতির এ অভিযোগ স্বীকারও করে নেয়।
এসডব্লিউ/এসএস/ ১৭০৫
আপনার মতামত জানানঃ