উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের নিয়ে করোনার এই ভয়াবহতার মধ্যে টালমাটাল বাংলাদেশ। এর মধ্যে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের ক্ষমতা দখল, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনাকে কমিয়ে দিয়েছে অনেক। এদিকে শিবিরে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা। গত ৪ বছরে বেড়েছে সাড়ে ৪ গুণ। অথচ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তোলা একটি প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি একপ্রকার এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এতে হতাশ বাংলাদেশ। বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘের এমন ‘উপেক্ষা’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে দায়মুক্ত করবে।
ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ফলে ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা আগে থেকেই বাংলাদেশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ছিল।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনের গ্রামে গ্রামে নতুন করে দমন অভিযান শুরু করলে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। এরপর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের কথায় উঠে আসে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ, যাকে জাতিগত নির্মূল অভিযান বলেছে জাতিসংঘ।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়টি ‘উপেক্ষিত’ থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার ও সহিংসতা বন্ধের আহ্বান নিয়ে পাস হওয়া প্রস্তাবের ক্ষেত্রে ভোটদানে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ।
যদিও পাস হওয়া এই প্রস্তাবটির পক্ষে ১১৯টি ভোট পড়ে, বিপক্ষে ভোট দেয় শুধু বেলারুশ। বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ ৩৬টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
জাতিসংঘে ভোটাভুটির পরদিন শনিবার এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে একটি বিবৃতি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল যে কারণ, তা স্বীকার করে না নিলে এবং তার সমাধানে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা না হলে মিয়ানমার বিষয়ে যে কোনো প্রস্তাব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
হতাশা প্রকাশ করে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, আমরা যা আশা করেছিলাম, এটি তার থেকে কম এবং এই রেজুলেশন একটি ভুল বার্তা দেবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ব্যর্থ হয়, তবে মিয়ানমার কোনও ধরনের দায়বদ্ধতা অনুভব করবে না।
প্রস্তাবে রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনও সুপারিশ বা পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব মৌলিক বিষয় প্রস্তাবে উঠে না আসায় বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
৪ বছরে সাড়ে ৪ গুণ বেড়েছে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা
ইউএনএইচসিআরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নতুন করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৩ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এর আগে ৩৭ হাজার ২১৬ পরিবারের এক লাখ ৫০ হাজার ৬৯৮ রোহিঙ্গার বসতি ছিল। এখন ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ রোহিঙ্গার বসতি।
এর মধ্যে শূন্য থেকে ৪ বছরের ৭০ হাজার ৭২৪ জন মেয়েশিশু, ৫ থেকে ১১ বছরের ৬১ হাজার ৮৮৩ জন ছেলেশিশু, ৯৭ হাজার ২৪৪ মেয়ে, ৯২ হাজার ৮২৪ জন ছেলে। এ ছাড়া ১২ থেকে ১৭ বছরের ৫৩ হাজার ৪২ জন মেয়ে এবং ১৮ থেকে ৫৯ বছরের মেয়ের সংখ্যা এক লাখ ৫৯ হাজার ১২৭ জন, ১৭ শতাংশ পুরুষ এক লাখ ৫০ হাজার ২৮৭ জন। ৬০ বছরের বেশি বয়সী নারী ১৭ হাজার ৬৮০ জন, পুরুষ ১৭ হাজার ৬৮০ জন।
উনচিপ্রাং শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ ইছুপ সহিংসতার শিকার হয়ে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেন। সে সময় পরিবারের চার সদস্য নিয়ে এসেছিলেন ইছুপ। এখন সদস্য সংখ্যা আটজন। এখনও সেই ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন তারা।
তিনি বলেন, দাতা সংস্থা থেকে দেওয়া ঘরের ত্রিপল, বাঁশ ও রশি সবই পুরোনো হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে ঘর তলিয়ে যায়। বাতাস হলে উড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। এখানে এসে নিজে চোখে না দেখলে অথবা না থাকলে সংকটের ব্যাপ্তি অনুধাবন করা খুবই কঠিন।
তিনি বলেন, প্রতি বছরে পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু তত থাকার জায়গা কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের শিক্ষা বিষয়ে চিন্তিত আমরা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাচ্ছে শিক্ষা ছাড়াই। তাদের ভবিষ্যতে কী হবে?
আগের তুলনায় ক্যাম্পে মারামারি, হানাহানি অনেকটা কমেছে উল্লেখ করে মোহাম্মদ ইছুপ বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া। সম্প্রতি নাফ নদ পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার চলে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার প্রাণহানির খবর পেয়েছি। কিন্তু আমরা সেভাবে যেতে চাই না। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার আমাদের দায়িত্ব নিয়েছে, তারাই সিদ্ধান্ত নেবে কীভাবে পাঠাবে। বর্তমানে মিয়ানমারে দুটি পক্ষ হয়ে গেছে। একটি পক্ষ রোহিঙ্গাদের মেনে নিতে রাজি। তাই মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের সময় এসেছে।’
এদিকে, ২০১৭ সালের আগে দুই হাজার পরিবারের সাড়ে ৮ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে গড়ে ওঠে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবির। এখন সেখানে ৩৬ হাজার ঘন মানুষের বসতি। চার বছরে সেখানে মানুষ বেড়েছে সাড়ে চার গুণ।
লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, প্রতি বছর মানুষ বাড়ছে। কিন্তু থাকার ঘরের জায়গা তা বাড়ছে না। এটা সত্যিই যে, গত কয়েক বছরে এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ উন্নতি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখন আগের মতো গুম, হত্যা ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটে না। তবে মাঝেমধ্যে মাদক উদ্ধারের মতো ঘটনা ঘটছে। করোনাকাল হওয়ায় বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে এ শিবিরে কোনো আয়োজন করা হয়নি। আমাদের একটি চাওয়া, সেটি হচ্ছে কখন নিজ দেশে ফিরে যাব।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪১৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ