জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যবহারের জন্য এখন অব্দি তেরোটি কোভিড-১৯ টিকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর কোনটিই শিশুদের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত নয়, যারা কিনা করোনা ভাইরাসে কম ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিস্থিতি হয়তো বদলে যাবে। গত ১৬ই মার্চ মর্ডানা, আমেরিকান ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা, ঘোষণা দিয়েছিল যে ছয় মাস থেকে বারো বছরের শিশুদের টিকা দেয়া শুরুর ক্ষেত্রে তারা অনেকটাই এগিয়েছে। ট্রায়াল চলছে। ফাইজার, আরও একটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান, বারো বছরের বেশি বয়সী শিশুদের উপর তাদের টিকার পরীক্ষা চালাচ্ছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা, একটি ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি, খুব শিঘ্রই ছয় থেকে সতেরো বছর বয়সী শিশুদের উপর টিকার ট্রায়াল শুরু করবে।
চলুন জেনে নিই, কেন প্রাপ্ত বয়স্কদের থেকে শিশুদের উপর টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ভিন্ন এবং কোভিড-১৯ প্রতিরোধে শিশুদের টিকাকরণে কী কী পার্থক্য আছে?
কোভিড-১৯ টিকা ভাইরাস ছড়ানো থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। টিকার মাত্র একটি ডোজ নিলেই, তা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অন্ততপক্ষে অর্ধেক কমিয়ে দেয় এবং ছড়ানোর সক্ষমতাও প্রায় অর্ধেক কমে যায়। এদিকে, শিশুরা এমনিতেও করোনা বিস্তারে খুব একটা ভূমিকা রাখে না। তবে কিছুটা বয়স্ক টিনএজাররা অবশ্যই ভাইরাস ছড়াতে পারে। যেমন দ্য লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডা. এ্যাডাম কুচারাস্কি জানিয়েছেন, সেকেন্ডারি স্কুলগামী বাচ্চারা করোনা ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম।
তবে এখন অব্দি, কোভিড-১৯ টিকা প্রস্তুতকারকদের প্রাথমিক টার্গেটের তালিকায় শিশুরা নেই। কারণ করোনা ভাইরাসে তারা খুব কম সংখ্যায় অসুস্থ হয়েছে। তবে যাই হোক, শিশুদের টিকার আওতায় আনলে, দেশের সমগ্র জনসংখ্যাকে কোভিড-১৯ থেকে বাঁচানো যে সহজ হবে তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের কাছেও ‘স্ট্রং এভিডেন্স’ আছে।
এছাড়া, শিশুদেরও কোভিড-১৯ টিকা নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বেশ কিছু সমীক্ষায় যদিও উঠে এসেছে যে শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের কোভিড-১৯ অতটা গুরুতর রূপ নেয় না, কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে তাদের টিকার প্রয়োজন নেই এবং শিশুদের সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি নেই। ১২ বছরের মধ্যে শিশুদের কোভিড-১৯ হলে হালকা অসুস্থতা বা কোনও উপসর্গই থাকে না। রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের দু’বার কোভিড টেস্ট করানো উচিত। যদিও গবেষকরা এখনও এটা অধ্যয়ন করে চলেছেন যে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের সংক্রমণের মধ্যে এই পার্থক্য কেন।
যে সকল শিশুর কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না তারাও কিন্তু সারস-কভ-২ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে এবং ছড়াতেও পারে। পাশাপাশি রেয়ার কিছু কেইস আছে, যেখানে আক্রান্ত শিশুর মধ্যে সম্ভাব্য মারাত্মক অবস্থা মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ডম দেখা যায় এবং কেউ কেউ পারসিসটেন্ট সিম্পটমে ভোগে, যা কিনা প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে ‘লং কভিড’-এ যে যে সমস্যা তৈরি হয়, সেগুলোই। প্রসঙ্গত, আমেরিকায় কমপক্ষে ২২৬ জন শিশু করোনা ভাইরাসে মারা গিয়েছে এবং হাজারের বেশি শিশু হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাই শিশুদের মধ্যে এই ঝুঁকি কমানোর জন্য টিকাকরণ প্রয়োজন, এর পাশাপাশি সামাজিক দুরত্ব ও মাস্ক পরাও বাধ্যতামূলক।
তবে এটা এখনও সংশ্লিষ্টদের কাছে স্পষ্ট নয়, কেন প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে শিশুরা কোভিড-১৯ এ কম ভোগে কিন্তু মানব শরীরের ইমিউন সিস্টেমে বয়স বাড়ার সাথে সাথে যে পরিবর্তন আসে, তার সাথে এর একটা সম্পর্ক বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে। ইমিউন সিস্টেম দু’ভাবে গড়ে ওঠে। প্রথমটি হলো জন্মগত, সহজাত। মানব শরীরে জন্ম থেকে থাকে এবং আঘাত, ফরেন বডিস এবং প্যাথজেন্সের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। দ্বিতীয়টি অভিযোজিত। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটি শরীর অর্জন করে থাকে। যখন সহজাত ইমিউন সিস্টেমটা শরীরে প্যাথজেন (এটি সেই সব ভাইরাসকেও মনে রাখে, যাদের দ্বারা ইতিপূর্বে শরীর আক্রান্ত হয়েছিল) ছড়ানোর ক্ষেত্রে বাঁধা দিতে ব্যর্থ হয়, তখন এই অভিযোজিত প্রক্রিয়াটি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।
তো এটা সম্ভব যে, শিশুদের সহজাত প্রক্রিয়াটা নতুন প্যাথজেন চেনার ক্ষেত্রে এবং তাদের প্রতিরোধ করতে বয়স্কদের থেকে অধিক কার্যকর। যদি ইমিউন সিস্টেমের ভিন্নতার কারণে কোভিড-১৯ শিশু এবং বয়স্কদের শরীরে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রভাব রাখে, তাহলে টিকার ক্ষেত্রেও এটি সত্য (যেহেতু টিকা মানব শরীরে একটি মক এ্যাটাক ঘটায়)। এই কারণে টিকা যে সকল বয়সের মানুষের জন্য নিরাপদ, সেটা প্রমাণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি গবেষকরাও দেখিয়েছেন, টিকার এই ব্যাপারটা আসলেই প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য সত্য। তারা কম বয়সীদের উপর আরও কিছু গবেষণা চালাচ্ছে। এর মধ্যে টিনএজার আছে, শিশু আছে, এমনকি নবিজাতকও আছে। এবং এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ‘ডি-এসক্লেশন’।
প্রাপ্তবয়স্কদের উপর কোভিড-১৯ এর যে সব ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়েছে, সেগুলো শিশুদের থেকে ভিন্ন। শিশুদের উপর চালানো ট্রায়ালে দেখা হবে, টিকা নেয়ার পর তাদের শরীরে কী পরিমাণ এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে, তাদের শরীরে কি প্রাপ্তবয়স্কদের মতো একই সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠছে (যদিও ট্রায়ালে আরও কিছু বিষয় দেখা হয়- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কেইস নাম্বার এবং লক্ষণ)। পাশাপাশি ট্রায়ালে শিশুদের সংখ্যা বেশ কম হয়; সেক্ষেত্রে ইতিমধ্যে টিকা গ্রহণ করা প্রাপ্তবয়স্কদের উপর চালানো ট্রায়ালে প্রাপ্ত এন্টিবডির পরিমাণ সম্পর্কিত তথ্য এবং অন্যান্য ফ্যাক্টগুলো যা সারস-কভ-২ এর ক্ষেত্রে ইমিউনিটি তৈরির বিষয়ে জানতে বুঝতে সাহায্য করে, তার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য তো থাকবেই।
মর্ডানাকে এখানে উদাহরণ হিসাবে দেখানো যায়। এটি ৩০ হাজার মানুষের উপর তাদের ফেজ-থ্রি ট্রায়াল চালিয়েছিলো। যার মাধ্যমে তারা প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেয়ার জন্য আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন থেকে অনুমোদন পায়। কিন্তু শিশুদের উপর মর্ডানার সাম্প্রতিক ট্রায়ালে মাত্র ৬ হাজার ৭৫০ জন অংশগ্রহণকারী আছে। তাই পার্থ্যকটা এখানে সুস্পষ্ট।
এদিকে, অনেক দেশই এই প্রত্যাশা করে আছে, এক সময় গণটিকাকরণের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা যাবে, যেখানে টিকা গ্রহণ কিংবা ইতিপূর্বে আক্রান্ত হবার কারণে জনসংখ্যার একটি বড় অংশের মধ্যে কোভিড-১৯ এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যাবে, এর ফলে সংক্রমণও থেমে যাবে। যে সব অঞ্চলে জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে (যেমন ইসরায়েল এবং ব্রিটেইন), সেখানকার তথ্য অনুযায়ী টিকা দেয়ার কারণে এই সব অঞ্চলে সংক্রমণ কমে এসেছে। কিন্তু পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ হলো ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা। তাদের টিকার আওতায় না আনা গেলে, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ পুরোপুরি থামানো যাবে না। সামনের গ্রীষ্মেই হয়তো শিশুদের উপর ট্রায়ালের তথ্য আমাদের সামনে আসবে। যতটা দ্রুত শিশুদের টিকা দেয়া যাবে, অতটা দ্রুতই করোনা ভাইরাসকে বশে আনা সম্ভব হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৫২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ