আসমা বারলাস : ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন শার্লি এব্দো নবী মুহাম্মদের কার্টুন গত সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় প্রকাশের সিদ্ধন্ত নিলে ঘটনাটি ফ্রান্সে আরেক দফা সেই হিংসাত্মক কার্যক্রমকে প্ররোচিত করে যা ২০০৫ সালে প্রথম প্রকাশের পর ঘটেছিলো। এবার, হামলার প্রতিক্রিয়ায় সরকারী ভাবেই কার্টুনগুলো পাবলিক বিল্ডিংয়ে প্রজেকশনের মাধ্যমে প্রচার করা হয়, যখন প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাখোঁর ঘোষণা দেন, “বিশ্বজুড়ে ইসলাম একটি সঙ্কটে পড়েছে, এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও এই ধর্মটি সঙ্কটে।” তিনি ফ্রান্স থেকে “মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের” বিদায় করার প্রতিশ্রুতি নেন।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে, আমি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে একটি আর্টিকেল লিখি এই বলে যে নবীর ক্যারিকেচারের কারণে মুসলিমরা মানুষ হত্যা করলে তাদের নিন্দা করা যাবে। সেই স্বীকৃতি পাওয়ার সাথে সাথে তারা মুসলমানদের উপরে তাদের সমালোচনার জ্ঞান মুন্সিয়ানার সঙ্গে চর্চা শুরু করে, তাদের মধ্যে একদল ইতোমধ্যে ফ্রান্স এবং ইউরোপে বেশ সংখ্যালঘু। আমি এই প্রশ্নও তুলেছিলাম যে ঐ ধরণের চিত্রগুলো পুনরায় অযৌক্তিক প্রদর্শন আদৌ বাকস্বাধীনতা চর্চার আওতায় পড়ে কিনা।
কিছু সমালোচক আমার প্রবন্ধটি এমনভাবে পড়েছেন যেন আমি মুসলমানদের হত্যাকাণ্ডকে প্রশংসাসূচক দৃষ্টিতে দেখেছি এবং বাকস্বাধীনতার ধারণা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই পরের কয়েকটি লাইনে আমি এই দুইটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত ইস্যুতে আলোকপাত করব: মুসলমানরা কীভাবে বাকস্বাধীনতা ও ম্যাঁখোরের ‘ইসলামী বিচ্ছিন্নতাবাদ’ নিয়ে প্রতারণাপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আসছে।
বাক-স্বাধীনতা বলা যায় মানুষের এমন কিছু আইডিয়া ও বিশ্বাসের নিরিখে যা কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়াশীলতার শঙ্কা ছাড়াই ব্যক্ত করার অধিকার রাখে। যদিও ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক এবং পশ্চিমা বিশ্ব নিজেই বাকস্বাধীনতার সেই প্রিন্সিপাল পরিষ্কারভাবে অনুসরণ করে না। কোরানও অন্যদের উপর জোর প্রয়োগ না করে বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাস করার অধিকার নিশ্চিত করে। এরই সাথে অত্যাচার, অবিশ্বাস এবং শারিরীক আক্রমণের মাধ্যমে অন্য ধর্মের ঈশ্বরদের ঘৃণা করতে নিষেধ করেছে। কোরান এই অবস্থায় পৌঁছাতে পেরেছে কারণ এটি বিভিন্ন ধর্মীয় ও বর্ণবৈচিত্র্য সমর্থন করে।
বাক-স্বাধীনতা বলা যায় মানুষের এমন কিছু আইডিয়া ও বিশ্বাসের নিরিখে যা কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়াশীলতার শঙ্কা ছাড়াই ব্যক্ত করার অধিকার রাখে।
আসমানী বাণীর এই বৈচিত্রগুলোই হলো দৈব অনুগ্রহের নিদর্শন। কিছু আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন হচ্ছে: আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণসমূহের মধ্যকার তারতম্য। এতে জ্ঞানীগণের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে।” (৩০:২২) অন্য আয়াতে এই বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয়েছে,
“আমি তোমাদের পারস্পরিক ব্যাপারসমূহে প্রত্যেককে একটি আইন ও পথ দিয়েছি। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন। (৫:৪৮) তা না করে, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।” (৪৯:১৩)
অবশ্যই, শুধু তখনই পারস্পরিক বোঝাপড়ায় পার্থক্য সৃষ্টি যখন লোকের সভ্য হতে চাওয়া ও না চাওয়ার মাঝে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। এজন্য কোরান বারবার মুসলিমদের সমালোচকদের সাথে তর্কে না জড়িয়ে ‘সর্বোত্তম আচরণের’ পরামর্শ দেয়, আর আক্রমণ করতে চাইলে ঐ পরিমাণ আক্রমণ করার পরামর্শ দেয় যতটুকু আক্রমণের শিকার মুসলমানরা হবে। তবে তা সবরকারীদের জন্যে উত্তম। (১৬:১২৫-১২৮)
মুসলিমদের জন্য অন্য ধর্মের ঈশ্বরদের নিয়ে উপহাস করাও নিষিদ্ধ যদি না তারা আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে উপহাস করে। তবুও তারা যদি তা করে তবে কোরান তাদের ক্ষতি করাকে সমর্থন করে না। তেমনি কোরান কারো অবিশ্বাস, ধর্মত্যাগ ও ব্লাসফেমির জন্য শাস্তি প্রদানও সমর্থণ করে না। ইনফ্যাক্ট, ব্লাসফেমির আরবি প্রতিশব্দ ‘তাজদীফ’ কোরানে নেই। এখানে উল্লেখ করা জরুরি, যে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে বর্তমানে ব্লাসফেমি আইন রয়েছে তা উপনিবেশ আমলে ইউরোপ থেকেই আমদানী করা হয়েছিলও।
যদি মুসলিমরা “পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারীদের” অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টানদের সাথে আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে কোরান আমাদের পরামর্শ দেয়, আমরা যেন তাদের নিশ্চয়তা দেই “আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবর্তীর্ণ হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের উপাস্য ও তোমাদের উপাস্য তো একই। এবং আমরা তারই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।” (২৯:৪৬)
ইসলাম চর্চা রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষত, ইউরোপে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু এবং অবরুদ্ধ অনুভব করে, ফলস্বরূপ প্র্যাক্টিসিং ইসলাম ব্যাপকভাবে কমে গিয়ে ইউরোপিয়দের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক রাজনৈতিক/সামরিক ইসলামে রূপ নিয়েছে।
যদি অবিশ্বাসীরা আমাদের চাপ প্রয়োগ ও হামলা করে থাকে তবে আমরা কোরানের সেই পরামর্শ অনুসরণ করতে পারি যা নবীকে দেওয়া হয়েছিল: “বলুন, হে কাফেরকূল, আমি এবাদত করি না, তোমরা যার এবাদত করো। এবং তোমরাও এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি এবং আমি এবাদতকারী নই, যার এবাদত তোমরা কর। তোমরা এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি। তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্যে। (১০৯:১-৬)
দুঃখজনকভাবে, এই ধরণের শিক্ষাগুলো মুসলমানদের মাঝে দেখা যায় না, এবং লোকেরা এভাবে ধর্মগ্রন্থ পাঠের বহু কারন রয়েছে। এর একটি কারণ হল ইসলাম চর্চা রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষত, ইউরোপে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু এবং অবরুদ্ধ অনুভব করে, ফলস্বরূপ প্র্যাক্টিসিং ইসলাম ব্যাপকভাবে কমে গিয়ে ইউরোপিয়দের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক রাজনৈতিক/সামরিক ইসলামে রূপ নিয়েছে। যদিও মুসলমানরা ইউরোপে তখন থেকে আছে যখন তারা অষ্টম শতাব্দীতে স্পেন জয় করেছিল কিন্তু তাদের জয় কখনো বৃদ্ধি ”জাতীয় ইসলাম” ছিল না।
বিপরীত দিক থেকে, ধর্ম থেকে প্রতিরোধের রাজনীতিতে এসে যে ধর্মহ্রাস ঘটেছে তার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খোদ ইসলামেরই। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, কোরানের সহনশীলতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং পারস্পরিক নৈতিকতার। এই ধরণের রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হলো ইউরোপের উপনিবেশবাদ, যা বর্তমান সময়ে ইউরোপের সাবেক কলোনি রাষ্ট্রসমূহে স্বদেশে মুসলমানদের উপস্থিতির জন্য দায়ী।
উদাহরণ হিসেবে, আলজেরিয়ানরা এখন ফ্রান্সে, কারণ এক সময় ফ্রেঞ্চরাও আলজেরিয়ায় ছিল। শুধু তাই নয়, ফ্রান্সের শাসনামলে এক মিলিয়ন আলজেরিয়ান নিহত হওয়ার দায়টাও তাদের রয়েছে। এটি শুধু মাত্র একটি সাবেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কলোনির উদাহরণ।
যাহোক, যেহেতু ফ্রেঞ্চরা তাদের জঘন্য এবং বেআইনি ইতিহাস মাটিচাপা দিয়ে রাখতে চায়, তাই চায় না কেউ এর প্রতিবাদ করুক যে ফরাসীরা অতীতের ভুক্তোভোগীদের এখনও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, মুসলমানদের দ্বারা সহিংসতার অভিযোগকে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া।
ইসলামের প্রতি যে ঘৃণা তা দেখে মনে হয় না এটি সেই দেশের শুধু ডানপন্থীরাই ধারণ করে। ব্যতিক্রমী এবং গ্রহণযোগ্য সেক্যুলারিজমের মৌলবাদ যাকে ‘লাসিত’ (laïcité) বলা হয় সেটির দ্বারা এটি অনুমোদিত। অন্যান্য সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলো ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ থেকে ধর্মীয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। কিন্তু ফ্রান্স তা করে না, যার সেক্যুলারিজমের মার্কা হলো নিখাঁদ জাতিগত জাতীয়তাবাদ এবং ইসলাম বিরোধিতা, এমনকি সেই মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মতই যারা নির্ধারণ করে দেয় মুসলিম মহিলাদের কোন ধরণের পোশাক পরা উচিৎ আর কোন ধরণের পোশাক পরা উচিৎ না।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্ব তাদের টেনে নিচে নামিয়েছে, যেকারণে মুসলিমদের জন্য, কালোদের জন্য, ফ্রান্স হলো একটি বর্ণবাদী, জাতিবিদ্বেষী কলোনিয়াল দেশের নাম। তাই, যখন একজন ফরাসী মুসলিম কোন অপরাধ করে বসে, রাষ্ট্র তার সাথে কোন নাগরিক সুলভ আচরণ করে না, করে ‘ইসলামিস্ট’ হিসেবে, সমষ্টিগত অপরাধ এবং সমষ্টিগত শাস্তিকে একটি নির্দিষ্ট বিশেষণে ভূষিত করে। আজ একজন ফরাসী মুসলমান হওয়ার অর্থ হলো, ইহুদি-তিউনেশিয়ান লেখক আলবার্ট মেমির ভাষায় ‘mark of the plural’ অর্থাৎ, কলোনাইজড কাউকে ব্যক্তি বিশেষে সংজ্ঞায়িত করা হয় না, তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় সামষ্টিকভাবে। যদি কোনো কলোনাইজড চাকর সকালে মালিকের বাসায় কাজে না আসে তবে তারা বলে না: সে অসুস্থ, বা সে চিটিং করেছে, অথবা রেগে আছে, অথবা বিরোধী দলে যোগ দিয়েছে। তখন মালিক তাকে আর গোনার ভেতরেই ধরে না। আলবার্ট মেমি ফ্রেঞ্চ কলোনাইজারদের এই টেন্ডেন্সি খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছেন একজন ‘নিরপেক্ষ’ তিউনেশিউয়ানের দৃষ্টিকোণ থেকে।
ম্যাখোঁরের দুশ্চিন্তা এখানেই, এটি যদি বিচ্ছিন্নতাবাদ হয়ে থাকে তবে লাসিত/রাষ্ট্র-নির্মিত জাতিবিদ্বেষ ভেঙে আবার শুরু করতে পারতেন। তা না করে তিনি সেই পুরাতন কলোনাইজারের মতন আচরণ করলেন। যার ব্যাপারে মেমি লিখেছেন: “The eulogizing of oneself and one’s fellows, the repeated, even earnest, affirmation of the excellence of one’s ways and institutions, one’s cultural and technical superiority do not erase the fundamental condemnation which every colonialist carries in his heart.”
উপনিবেশন অতীত থেকে ম্যাখোঁর অন্তত একটি শিক্ষা নিতে পারতেন, সেটি হলো, ”উপনিবেশবাদ যদি তাদের অধ্যুষিত অঞ্চলকে ধ্বংস করে থাকে তবে সেটি ঔপনিবেশককেও ভেতর থেকে পচিয়ে ফেলে।” উপনিবেশন অতীত থেকে ম্যাখোঁর অন্তত একটি শিক্ষা নিতে পারতেন, সেটি হলো, ”উপনিবেশবাদ যদি তাদের অধ্যুষিত অঞ্চলকে ধ্বংস করে থাকে তবে সেটি ঔপনিবেশককেও ভেতর থেকে পচিয়ে ফেলে।”
আসমা বারলাস
পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত নিউ ইয়র্কের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর অব পলিটিক্স
[এই নিবন্ধটি ১১ নভেম্বর, ২০২০ আলজাজিরা ইংরেজি বিভাগে প্রকাশিত]
এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং এটি State Watch এর সম্পাদকীয় নীতির আদর্শগত অবস্থান নয়।
Available for everyone, funded by readers. Every contribution, however big or small, makes a real difference for our future. Support to State Watch a little amount. Thank you.
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ