উদ্বেগ আছে উদ্যোগ নেই। দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। ইতিমধ্যে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি সংক্রমণ বাড়ছে। জানা গেছে, করোনাভাইরাসের ব্রিটিশ ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ৪০ শতাংশ বেশি সংক্রামক। এর মধ্যেই দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সংকট দেখা দিয়েছে। সীমান্তবর্তী উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেই পর্যাপ্ত অক্সিজেন। জেলা পর্যায়ে রয়েছে আইসিইউ’র ঘাটতি। ঘাটতির দেশে, শুধু ঘাটতি নেই শনাক্তের হারে। দেশের বেশ কিছু জেলায় ইতিমধ্যেই শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বাড়ছে মৃত্যুও। বাড়ছে উদ্বেগ। কমছে উদ্যোগ।
মংলায় শনাক্তের হার ৪০-৭০ শতাংশ
বাগেরহাটের মংলায় গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণের হার ৪০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে, যা নিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। উপকূলীয় এ উপজেলায় গত কয়েকদিনে পরীক্ষা অনুপাতে করোনা ভাইরাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে।
বাগেরহাটের সিভিল সার্জন কে. এম হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, পুরো বাগেরহাট জেলার পরিস্থিতি নাজুক না হলেও মংলা উপজেলায় সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। মংলা উপজেলায় সংক্রমণ ২৬ তারিখ থেকে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের জেলায় এখন রোগী চিকিৎসাধীন আছে ২৬৪ জন। এর মধ্যে ১৬৪ জন মংলা উপজেলায়।
শনাক্তের হার উঠানামা করছে এই উপজেলায়। সূত্র মতে, প্রথম তিন দিন ছিল ৭০ পার্সেন্ট। গত ৩ ও ৪ জুন ছিল ৪০ পার্সেন্ট, ৫ জুন আবার ৭০ পার্সেন্টে পৌঁছায়।
সাতক্ষীরায় শনাক্তের হার ৫৯.৩৪ শতাংশ
গত ২৪ ঘণ্টায় সাতক্ষীরায় ১৮২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত ১০৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৫৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। জেলায় বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত ৫৫১ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে ১১২ জন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ২৩ জন জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বাকিরা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আজ বুধবার জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা উপসর্গ নিয়ে চার জনের মৃত্যু হয়েছে এ জেলায়। এদের মধ্যে দুই জনের বাড়ি সাতক্ষীরা শহরে, একজনের বাড়ি শ্যামনগর উপজেলায় ও একজনের বাড়ি সদর উপজেলার আগরাতলা এলাকায়।
এদিকে, করোনা সংক্রমণের রাশ টানতে সাতক্ষীরায় লকডাউন ঘোষণা করা হলেও জনসমাগম বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জেলার স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. হোসাইন সাফায়াত বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির যে হারে অবনতি হচ্ছে, তাতে কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই। কেবলমাত্র চিকিৎসা সেবা দিয়ে সাতক্ষীরায় করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।’
নাটোরে শনাক্তের হার ৫২.২৭ শতাংশ
গত ২৪ ঘণ্টায় নাটোর জেলায় ৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত আরও ৪৬ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৫২ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ছিল ৬৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। আজ বুধবার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে।
একই সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দুই জন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নাটোরের দুই পৌর এলাকায় আজ থেকে শুরু হয়েছে সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউন। আজ ভোর ৬টা থেকে নাটোর ও সিংড়া— এই দুই পৌর এলাকায় লকডাউন শুরু হয়।
লকডাউন যথাযথভাবে কার্যকর করতে তৎপর আছে পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) লিটন কুমার সাহার নেতৃত্বে সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয় পুলিশ। অপ্রয়োজনীয় চলাচল এড়াতে সড়ক ও গলিপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. শাহ রিয়াজসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও লকডাউন কার্যকর করতে মাঠে রয়েছেন।
রাজশাহীতে শনাক্তের হার ৫০.২৭ শতাংশ
রাজশাহীতে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনা শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গত শনিবার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের দুটি ল্যাব থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এদিন এই বিভাগে সর্বোচ্চ ৫০২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়।
রাজশাহীতে ৩৬৬ টি নমুনা পরীক্ষায় ১৮৪ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৭৬ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১০৮ জনের করোনা পজেটিভ আসে। অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষায় রাজশাহীতে ৫০.২৭ শতাংশ ও চাপাইনবাবগঞ্জে ৬১.৩৬ শতাংশের করোনা শনাক্ত হয়।
শনাক্তের মধ্যে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২২২ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৪২ জন, জয়পুরহাটে ৫২জন, বগুড়ায় ২৬ জন, নাটোরে ২১ জন, নওগাঁয় ২০ জন, পাবনায় ১৫ জন এবং সিরাজগঞ্জে ৪ জন রয়েছে।
যশোরে শনাক্তের হার ৪৯ শতাংশ
গত ২৪ ঘণ্টায় যশোর জেলায় ২৪ ঘণ্টায় ২৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে নতুন করে ১৪৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এতে দেখা যায় শনাক্তের হার ৪৯ শতাংশ।
এ ছাড়া যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একজন করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে এবং অপরজন আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আখতারুজ্জামান।
এ পর্যন্ত জেলায় ৭ হাজার ৭০১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮৪ জন। এ ছাড়া যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৭২ জন।
কুষ্টিয়ায় শনাক্তের হার ৩০.১৮ শতাংশ
কুষ্টিয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৬৭ জনের। এছাড়া কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
আজ সকাল সাড়ে নয়টায় হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকার বলেন, মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও দুজন নারী। চলতি বছরে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে একসঙ্গে চারজনের মৃত্যু এটাই প্রথম।
গতকাল রাত ১০টায় জেলা প্রশাসন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এক দিনে সর্বোচ্চ ৬৭ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। ২২২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে চলতি বছরে এটাই সর্বোচ্চ শনাক্ত। শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ১৮ শতাংশ। তাদের মধ্যে কুষ্টিয়া সদর উপজেলাতেই ৪৩ জন রয়েছেন।
খুলনায় শনাক্তের হার ২৯.৬৭ শতাংশ
খুলনায় বাড়ছে সংক্রমণ। বাড়ছে মৃত্যু। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনায় আক্রান্ত ৮১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। খুলনা জেলার ১৯৩টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৯ জন কোভিড পজিটিভ পাওয়া গেছে। খুলনায় জেলায় শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। খুলনায় এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৯৫১ জন। আজ বুধবার করোনা ফোকাল পারসন ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সুহাস রঞ্জন হালদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা সবাই কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘করোনায় মৃত ছয় জনের মধ্যে তিন জনের বাড়ি খুলনায়। বাকিদের মধ্যে দুই জনের বাড়ি বাগেরহাটে ও একজনের বাড়ি যশোরে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১০১ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন ১৯ জন।’
রংপুরে শনাক্তের হার ২৮.৭৯ শতাংশ
রংপুর বিভাগের আট জেলায় পাওয়া শেষ তথ্য অনুযায়ী নতুন করে ১১৪ জন করোনা পজিটিভ হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন ৪৭ জন রোগী। একই সময় বিভাগের ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে রংপুর বিভাগে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৪১৬-তে পৌঁছেছে।
স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সোমবার (৭ জুন) বিভাগের ৮ জেলার ৩৯৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে নতুন করে ১১৪ জন করোনা পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে। এতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
ভারত থেকে যারা আসছে তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা যাতাযাত করছে। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী লোকজন কোনো না কোনোভাবে ভারতীয় মানুষের সংস্পর্শে আসছে এবং তারা সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে অবাধে যাওয়া-আসা করছে। এছাড়া যারা অবৈধভাবে দেশে আসছে, তাদের তো কোনপ্রকার কোয়ারেন্টিনে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই মানুষের মধ্যে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, যে হারে করোনা উপসর্গ নিয়ে মানুষ চিকিৎসা নিতে আসছে, সেই হারে এখন চিকিৎসক বা নার্স নেই। আবার অন্যান্য সুবিধা দিতেও আমাদের হিমিশিম খেতে হচ্ছে। বেশির ভাগ রোগীই আসছে খারাপ পরিস্থিতি নিয়ে। এ কারণে মৃত্যুর হার বাড়ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৫৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ