বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গেল পাঁচ বছরে বিদেশে অর্থ পাচারের ১ হাজার ২৪টি ঘটনা ঘটেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। এসময়ই ঘটেছে অর্ধেকের বেশি অর্থ পাচারের ঘটনা।
বিএফআইইউর প্রতিবেদন মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১৬টি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫২টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৭৭টি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২১টি ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৮টি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে।
১ হাজার ২৪টি অর্থ পাচারের ঘটনার অর্ধেকই বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। এর বাইরে গত পাঁচ অর্থবছরে ২ হাজার ২৯০টি অর্থ পাচারের ঘটনার তথ্য সরবরাহ করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
দেশে ও দেশের বাইরে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিএফআইইউ। সংস্থাটি যেসব ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে, তার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। যেসব সংস্থার কাছে এসব প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও এসব ঘটনায় কোনো সংস্থা খুব বেশি ব্যবস্থা নেয়নি।
অর্থ পাচারের ঘটনা মাঠপর্যায়ে সরাসরি তদন্তে যুক্ত বিএফআইইউর দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সব তথ্যপ্রমাণসহ অর্থ পাচারের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। পাচারকারী দেশের বাইরে কোথায় ফ্ল্যাট, বাড়ি কিনেছেন বা বিনিয়োগ করেছেন, তার বিবরণও সেখানে আছে।
বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, ‘আমরা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিই। তারা আরও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়। এখন অনেকগুলো ঘটনার মামলা চলছে। আদালতের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে তো কেউ শাস্তির আওতায় আসবে না। দেশের বাইরে থেকে অর্থ ফেরত আনা জটিল প্রক্রিয়া। ওই দেশের সমর্থন প্রয়োজন হয়।’
দেশে কার্যত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি ও মানি একচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিমাসে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে দিয়ে থাকে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রাক্কলন অনুযায়ী কর ফাঁকি দিতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করতে, কোম্পানির মুনাফা লুকাতে এবং অন্যান্য কারণে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে অনেক সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে বছরে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। করের স্বর্গ বলে পরিচিত দেশে মুনাফা এবং সম্পদ স্থানান্তর করে বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিচ্ছেন বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও ব্যক্তি পর্যায়ের করদাতারা।
সম্প্রতি ট্যাক্স জাস্টিজ নেটওয়ার্ক নামে একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম এ প্রাক্কলন করেছে। এর আগে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে অর্থ পাচারের তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে প্রকাশ করে। আইসিআইজে ২০১৩ সালে অফশোর কোম্পানির উদ্যোক্তা এমন ৩২ জন বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করে। ২০১৬ সালে আইসিআইজের পানামা পেপারসের ডাটাবেজে ৫৬ জন বাংলাদেশির নাম রয়েছে। ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপারসে ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে একই পেপারসের সংযোজনীতে ২২ বাংলাদেশির নাম পাওয়া যায়।
আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনা অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলার দায়িত্ব এনবিআরের অধীন সংস্থা শুল্ক্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের। ২০১৯ সাল থেকে এই অধিদপ্তর এ বিষয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে ৫০টির বেশি মামলা করেছে সংস্থাটি। চারটি মামলার চার্জশিটও দিয়েছে। এই অধিদপ্তরের অধীনে আলাদা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ দপ্তর গঠনের প্রস্তাব করা হলেও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এখনও তার অনুমোদন দেয়নি। এই অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থ পাচার রোধ ও পাচার করা অর্থ ফেরত আনার জন্য যে ধরনের সাহসী, উদ্যমী ও দক্ষ টিম থাকা দরকার, তা বর্তমানে নেই।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাচার অর্থ উদ্ধারের জন্য লাগাতার লেগে থাকতে হবে। এ জন্য বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডি, এনবিআর ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সব সংস্থা একযোগে কাজ না করে শুধু একটা চিঠি দিয়ে দায়িত্ব শেষ মনে করলে চলবে না। বরং তথ্য পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লেগে থাকতে হবে। নিখুঁত তদন্ত করে মামলা করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১২
-State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ