রাশিব রহমান
বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবার বাজেট প্রণয়নেও সুবর্ণজয়ন্তী পালন করল। জনগণের টাকায় এবং জনগণের জন্য করা বাজেটে জনগণের মতামত নেবার ন্যূনতম সুযোগ না রেখে (জনগণকে মতামত দেবার উপযুক্ত হতে না দিয়ে এবং বাজেট প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা না করে) ব্যবসায়ী সংগঠনসমূহ এবং সরকারের পোষা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এবং ৭০ ধারা মাথায় ঝোলানো সংসদ সদস্যদের হাত তোলা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পাশ করানো বাজেট গণমুখীই হোক আর গণবিরোধীই হোক, বাস্তবায়নযোগ্যই হোক আর কল্পনাবিলাসীই হোক, গরিববান্ধবই হোক আর গরিব মারারই হোক, কোনভাবেই তা গণতান্ত্রিক বাজেট হতে পারেনা। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত অথবা প্রশাসনিক কারসাজিতে নির্বাচিত অথবা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, যেমন সংসদই হোক না কেন, সংসদ সদস্যদের নিজেদের মতামতকেই জনগণের মতামত হিসেবে প্রচার করা কখনোই নৈতিক হতে পারে না। প্রতি বছর বাজেটের আকার বৃদ্ধি পায়, এবারো পেয়েছে। তবে বিষয়টি কতটা কৃতিত্বের সেটা ভাবার বিষয়। ১৯৭২ সালে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির দেশের বাজেটের থেকে ২০২১ এ সাড়ে তিন শতাধিক বিলিয়ন ডলারের জিডিপির দেশের বাজেট বড় হবে এতে বিস্ময় অথবা কৃতিত্বের কিছু থাকতে পারে কী? এবারের ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণের মাধ্যমে ব্যবস্থা করা হবে। বিগত কিছু বছর ধরে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করে, এবারো করেছে। তাঁদের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৩৮ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১ টাকাও ঋণ করতে হবে না। ভালো হত যদি সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক প্লাটফর্ম এবং পেশাজীবীরাও তাঁদের মতানুযায়ী বিকল্প বাজেট ঘোষণা করতেন আর সরকার বাহাদুর সে মতগুলোকে পর্যালোচনা করে সর্বাধিক যুক্তিগ্রাহ্য মতকে গ্রহণ করার মত গণতান্ত্রিক মনোভাবসম্পন্ন হতেন। তবে সেসব অন্তত নিকট ভবিষ্যতে প্রত্যাশা করাটাও আকাশ কুসুম হয়েই থাকবে মনে হচ্ছে।
অতিমারির দুই তরঙ্গের আঘাতে বিপর্যস্ত জনজীবন পুণর্গঠন ও তৃতীয় তরঙ্গের চোখরাঙানিকে প্রতিহত করতে বাজেটে প্রয়োজন ছিল বিশেষ পরিকল্পনার। কিন্তু পরিসংখ্যানগত তারতম্যের বাইরে বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলার কোন কর্মকৌশল ঘোষিত হয়নি।
অতিমারিকালীন কোন কিছুই আর আগের পৃথিবীর সাথে সুষমতালে নেই। এমন একটি সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক যেকোন পরিকল্পনায় যদি স্বাভাবিক সময়ের পরিকল্পনার রেখাচিত্রের সাথে বৈসাদৃশ্য দৃশ্যমান না হয় তবে
বুঝতে হবে পরিকল্পনাকারী পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন। অতিমারির দুই তরঙ্গের আঘাতে বিপর্যস্ত জনজীবন পুণর্গঠন ও তৃতীয় তরঙ্গের চোখরাঙানিকে প্রতিহত করতে বাজেটে প্রয়োজন ছিল বিশেষ পরিকল্পনার। কিন্তু পরিসংখ্যানগত তারতম্যের বাইরে বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলার কোন কর্মকৌশল ঘোষিত হয়নি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ গতবারের মত না থাকলেও ঘুরপথে থাকছে। বাজেটে এবার এ বিষয়ে কোন কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ, গতবারের মত শেয়ারবাজার বা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে টাকা সাদা করার সুযোগ ৩০ জুনের পর না থাকার কথা। কিন্তু আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী ২০২৪ সাল পর্যন্ত হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ তো থাকছেই। তাই মিছে বাজেটে এ আলোচনা রেখে হৈচৈ না তোলাই বুদ্ধিমানের কাজ। বরং বাজেট আলোচনা মিইয়ে গেলে ভিন্নপথে সুযোগকে সম্প্রসারণ করে দিলে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। স্মর্তব্য, সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন এক মাস পর কালো টাকা সাদা করা বিষয়ে স্পষ্ট করা হবে।
অতিমারিতে ব্যাপকভাবে উন্মোচিত হয়েছে স্বাস্থ্যখাতের দীনতা। স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেখানে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার, সেখানে বর্ধিত থোক বরাদ্দের পরিমাণ কোন আশার আলো নির্দেশ করেনা। যেটুকু বরাদ্দ তাও যে খুব একটা কাজে আসবে না তা বলে দেয়া যায় খাতটির দুর্নীতিপরায়ণতা ও অব্যবস্থাপনার রাশি রাশি ঘটনার পৌণপুণিকতা দেখে। ছিদ্র বন্ধ না করে জলসিঞ্চন লক্ষ্যে পৌঁছার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
ভয়াল অতিমারিতে আয় কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের। নতুন দরিদ্র প্রায় তিন কোটি। সেখানে মাননীয় অর্থমন্ত্রী নতুন দরিদ্র হওয়া মানুষ বিবেচনায় না নিয়ে দুই বছর আগের পরিসংখ্যান দিয়ে দরিদ্রের হিসেব কষেছেন। অতিমারির আঘাতে কর্মসংস্থানে যে ধ্বস নেমেছে, তা মোকাবেলায় প্রয়োজন ছিল বিশেষ মনোযোগের। মন্ত্রী নিজেই এটিকে ব্যবসাবান্ধব বাজেট ঘোষণা দিয়েছেন, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও তা স্বীকার করে নিয়ে স্বাগত জানিয়েছে। মন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে ব্যবসা বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু সেটি সম্ভবত দুরাশা। গত বছর সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর তৈরি পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধে মালিকেরা প্রণোদনা পেলেও যথাসময়ে ও যথানিয়মে শ্রমিকের প্রাপ্তি ঘটেনি বলে ব্যাপক আলোচনাও হয়েছে। সেখানে কর্পোরেট কর কমালেই কর্মসংস্থান বাড়বে এমন আশা কাজ হারানো শ্রমিক ও নতুন কর্মসন্ধানীদের না করা-ই ভালো। কর ছাড়ের সুযোগ গুটিকয় বৃহৎ পুঁজিপতি যতটা নিতে পারবেন নিশ্চিতভাবেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ততটা সক্ষম হবেন না; যেমনটি হননি গত বছরের প্রণোদনার বেলায়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পর্যায়ে স্বল্প সুদের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, অথচ নানা অজুহাতে বড় পুঁজিপতিদের ঋণ প্রাপ্তি ও রিশিডিউলিং এ সমস্যা হয়নি। গড়পড়তা প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার পার পেলেও জনগণের সংকট মোচনে তা খুব কাজে আসবে বলে মনে হয় না। আবার বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির আশ্বাস শুনিয়ে রাষ্ট্র তার নিজের দায়িত্বকে আরো একবার অস্বীকার করার প্রয়াস পেল।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী এগুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। কেন এবং কীভাবে আইনত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান লাভজনক ব্যবসাক্ষেত্রে পরিণত হল তা তলব না করে ভ্যাট আরোপ প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হবে।
বাজেটে মাসে ২৫ লাখ জনের এবং সর্বমোট ৮০ শতাংশ মানুষের করোনা টিকা নিশ্চিতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ৮০ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় আসলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্বাভাবিক গতি আসতে পারে বলে আশা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মাসিক লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সাড়ে চার বছর সময় লাগবে। তবে কি এসময় জুড়ে অর্থনীতির মন্থর কাল চলবে?
মোবাইল ব্যাংকিং এখন স্বল্পআয়ের মানুষের আর্থিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম। এখানে করবৃদ্ধি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আরো বিপর্যস্ত করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী এগুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। কেন এবং কীভাবে আইনত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান লাভজনক ব্যবসাক্ষেত্রে পরিণত হল তা তলব না করে ভ্যাট আরোপ প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হবে।
শেষ করি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুঈদ রহমানের মত ধার করে। দৈনিক যুগান্তরে ৬ জুন, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত কলামে তিনি মত দিয়েছেন যে, যে দেশের সরকারগুলো কালোটাকার মালিকদের কিছু বলতে পারে না, ঋণখেলাপিদের ভয় পায়, অর্থ পাচারকারীদের সমীহ করে, দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আপস করে চলে, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংককে প্রধান পরামর্শক মনে করে, সেদেশে প্রতিবছরই গতানুগতিক বাজেটের ওপরই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হই।
রাশিব রহমান, প্রাবন্ধিক
আপনার মতামত জানানঃ