২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের আকার জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন শুরু করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় তাঁর বাজেট বক্তৃতা শুরু হয়। এর আগে মন্ত্রিসভায় বাজেটে অনুমোদন হয়। তবে এই বাজেটে এবারই প্রথম ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ কোটি টাকা বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। সঞ্চয়পত্র থেকেও ধারের অঙ্ক কিছুটা বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর–সংগৃহীত কর থেকে পাওয়া যাবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, এনবিআর–বহির্ভূত কর থেকে আসবে ১৮ হাজার কোটি টাকা আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে, মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গত বাজেটে এ হার ছিল ৬ দশমিক ২। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে এ ঘাটতি মেটানো হবে বলে জানানো হয়েছে।
ঘাটতির মধ্যে অনুদানসহ বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা; আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, এর মধ্যে আবার ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরের জন্য বড় ঘাটতি রেখে যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে নির্ভর করতে হবে বড় অঙ্কের ঋণের ওপর। আর এই ঋণের প্রায় অর্ধেক নেয়া হবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে।
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে ব্যাংক থেকেই ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ধার করার পরিকল্পনা রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানাবিধ অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব খাত থেকে জোগান দেয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
ঘাটতির এই পরিমাণ আগের যেকোনো বছরের তুলনায় বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে এই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। আর সে জন্য নতুন বাজেটে বিদেশি ঋণের নির্ভরতা অনেকটাই বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এবার বিদেশ থেকে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা আসবে বলে আশা করছেন তিনি। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন কামাল।
প্রতি বছর বড় হচ্ছে বাজেটের আকার। তবে ব্যয় বাড়লেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না আয়। ফলে বড় হচ্ছে ঘাটতির অঙ্ক, আর সে জন্যই বাড়ছে ঋণনির্ভরতা।
আর এই ঘাটতি পূরণে বড় নির্ভরতার জায়গা হচ্ছে ব্যাংক। এবারই প্রথম ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ কোটি টাকা বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। সঞ্চয়পত্র থেকেও ধারের অঙ্ক কিছুটা বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ১ হাজার ৬ কোটি ৩৩৪ টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার ১ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে।
বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা।
পাচার করা টাকা হবে বৈধ
দেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ বাজেটে বৈধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কর দিয়ে এসব অর্থ বৈধ হয়ে গেলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনো কর্তৃপক্ষ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছেন।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরে আমাদের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে।
এমতাবস্থায়, আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অধিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারি ব্যয় নির্বাহের জন্য এক দিকে আমাদের অধিক পরিমাণে রাজস্ব জোগান দিতে হবে, অন্য দিকে বেসরকারি খাতেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনতে হবে। এ অবস্থায় বিদেশে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ অর্থনীতির মূল স্রোতে আনার মাধ্যমে বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেন।
নতুন বিধানের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী বিদেশে অবস্থিত যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যে কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে ১০ শতাংশ ও বাংলাদেশে পাঠানো (রেমিটকৃত) নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করেন তিনি। এ সুবিধা ২০২২ সালের ১ জুলাই হতে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত বিধান কার্যকর হলে অর্থনীতির মূল স্রোতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে, আয়কর রাজস্ব আহরণ বাড়বে; আর করদাতারাও বিদেশে অর্জিত অর্থ-সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে স্বস্তিবোধ করবেন।
অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুমোদন হলে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফিরবে। আর সেই অর্থ মিশে যাবে অর্থনীতির মূল প্রবাহে। এর মাধ্যমে সংকট কাটিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল করার কথা বলেছেন তিনি।
বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনা প্রসঙ্গে অর্থ পাচার রোধে কাজ করা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহা রাজী হাসান বলেন, ‘যাঁর অর্থ তিনি চাইলে উন্নত দেশগুলো থেকে ফেরত আনতে পারবেন; কারণ ওই দেশগুলো থেকে টাকা পাঠাতে আইনি বাধা নেই। তবে ওই দেশগুলোতে অর্থের বৈধতা, অপরাধ ও কর ফাঁকির অভিযোগ থাকলে ফেরত আনা কঠিন।’
এসডব্লিউ/এসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ