প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দেশের প্রথম শ্রেণির (‘এ’ ক্যাটাগরি) ১৯৪ পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। দেশের মোট ৩২৮ পৌরসভার মধ্যে ১৯৪টিতেই পর্যায়ক্রমে প্রধান নির্বাহীর চেয়ারে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দীর্ঘ দিন পদটি ফাঁকা ছিল, যদিও স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী এ পদে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের সুযোগ ছিলই। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে সম্প্রতি এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। গত সপ্তাহে মেহেরপুর ও কক্সবাজার পৌরসভায় সরকারের সহকারী সচিব পদের দুই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আমলাকেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন
তবে এটি একটি নতুন চাপ বলে মনে করছেন মেহেরপুর পৌরসভার মেয়র মো. মাহফুজুর রহমান রিটন। তিনি জানান, ক্ষমতা আমলাদের পুরো কবজায় নিতে এখানে ক্যাডার কর্মকর্তাদের বসানো হচ্ছে। কারণ, পৌর মেয়ররাই এত দিন ‘প্রধান নির্বাহী’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আর প্রশাসনিক কার্যক্রমে ‘সচিব’ দায়িত্ব পালন করেন। এখন নতুন করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদায়নে পৌরসভার আর্থিক ক্ষতিসহ দাপ্তরিক কাজেও জটিলতা তৈরি হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, এখানে আমার বক্তব্যটা একটু ভিন্ন। এটা কোনো পক্ষের সঙ্গেই মিলবে না। পৌরসভাগুলো বহু বছর ধরেই দৈন্যদশায়। এই দীর্ঘ দিনের সমস্যার সমাধান করছি না। প্রত্যেকেই নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে যা করার দরকার, তা-ই করছে। আমলাতন্ত্র শক্তিশালী করতে এখন একজন কর্মকর্তা দেওয়া হচ্ছে।
এখন থেকে পৌরসভায় মন্ত্রণালয় থেকে তাদের পদায়ন করা কর্মকর্তার সঙ্গেই সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করা হবে। মেয়ররা এ বলয়ের বাইরে থাকবেন। আর মেয়ররা রাজনৈতিক লোক। কিন্তু তারা এখন নিজ দলের বাইরে কোনো কথা বলেন না। এই যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তারা কথা না বলে নিজ দলের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে ‘নিজের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারেন’। ফলে আইনের ফাঁকে আমলারা তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘মেয়ররাও নিজেদের একক ক্ষমতায় বিশ্বাসী। তারা কাউন্সিলরদের গুরুত্ব দেন না। সবাইকে নিয়ে সভা করে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তারা করেন না। এখন মেয়র মনে করেন নিজের সিদ্ধান্তে সব হবে আর আমলাতন্ত্র মনে করে তাদের সিদ্ধান্তে কাজ চলবে। এ প্রতিযোগিতায় আমলাতন্ত্র জয়ী হয়। মেয়ররা পরাজিত হন। ’
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এই মুহূর্তে সবগুলো সম্ভব না হলেও যেন ৬৪ জেলার মধ্যে সিটি করপোরেশন বাদ দিলে বাকি ৫২টি পৌরসভায় যেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশাসন ক্যাডার থেকে দেওয়া হয়, সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, গত ২৩ মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদ জনপ্রশাসন সচিবের কাছে চিঠি পাঠান। সেখানে বলা হয়, ‘প্রতিটি পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়নের জন্য পর্যায়ক্রমে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদায়ন করা পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করে দেশের সকল জেলা সদরের পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত একজন “সিনিয়র সহকারী কমিশনার” বা “সহকারী কমিশনার”কে তার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।’
এরপরই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে দুজনকে পদায়ন করা হয়। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘১ জুন মেহেরপুর পৌরসভায় সহকারী সচিব মো. মেহেদী হাসানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের সেই আদেশে পৌরসভার তহবিল হবে বেতন-ভাতা, সব বাধ্যতামূলক চাঁদা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গোষ্ঠীবীমা, কল্যাণ তহবিল ফান্ড ও বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। ’
পদ নিয়ে জটিলতা, বেতন নিয়ে অসন্তোষ
মেহেরপুর পৌরসভায় গত সপ্তাহে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার থেকে একজন কর্মকর্তাকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পদায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করেন পৌরসভার মেয়র মাহফুজুর রহমান রিটন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৌর সভায় সারা দেশেই দ্বিতীয় শ্রেণির একজন কর্মকর্তা “সচিব” দিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এতে কোথাও কোনো অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে করি না। সেখানে নতুন করে “প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা” হিসেবে একজনকে পদায়ন করা হলো।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিগুণ হওয়ার পর বেশির ভাগ পৌরসভায় নিয়মিত বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বকেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টরা বছরব্যাপী আন্দোলন করে। এরই মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হচ্ছে। এতে আমাদের কাজের যেমন জটিলতা তৈরি হবে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে পৌরসভাগুলোকে নতুন করে চাপে পড়তে হবে।’
তবে তিনি এও বলেন, ‘সরকার কাউকে দিতে চাইলে তো আমাদের কিছু করার নেই। যাকে দেবে তাকে নিয়েই কাজ করতে হবে। ’ পৌর মেয়র ও সংশ্লিষ্টদের দাবি, পৌরসভায় প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য কর্মকর্তা ধাপে পদটি হলো ‘সচিব’। এ পদটি বরাবরই আইন দ্বারা সুনির্দিষ্ট করা আছে। সেভাবেই পৌরসভা অধ্যাদেশ, ১৯৭৭ (অধ্যাদেশ নং-২৬)-এর ৪১(১) নম্বর ধারায় পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিষয়ে বলা আছে।
কিন্তু ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের আমলে পৌরসভা অধ্যাদেশ, ১৯৭৭-এর ৪০ নম্বর ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ৪২ নম্বর ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদ সৃষ্টি করা হয়। এরপর ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে আবার ‘সচিব’ পদের অধস্তন বিভিন্ন শাখাপ্রধানের পদমর্যাদা ও বেতনক্রম সচিব পদের সমান করা হয়।
ফলে ‘সচিব’ পদের পদমর্যাদা ও বেতনক্রমের মান প্রচলিত আইন ও বিধি মোতাবেক সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পুনর্নির্ধারণ না করায় কার্যত এ পদের গুরুত্ব ও মর্যাদা অস্বাভাবিকভাবে অবনমিত হয়েছে। এতে পৌর প্রশাসনে কর্মরতরা চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছে। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়ছে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পৌরসভার সার্বিক কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, স্বয়ংসম্পূর্ণ পৌরসভা চাকরি কাঠামোয় ‘প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা’ পদটি যুক্ত করে ভিন্ন সার্ভিসের জনবল দিয়ে তা পূরণ করার বিধান রাখায় পৌরসভার চাকরিতে ‘সচিব’ পদের আইনগত স্বত্ব, মর্যাদা ও গুরুত্ব চরমভাবে খর্ব হয়েছে। বাস্তবে পৌরসভার মতো ক্ষদ্র অধিক্ষেত্রে একই ধরনের ‘সচিব’ ও ‘প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা’ এ দুটি পদ রাখার কোনো যৌক্তিকতা বা প্রয়োজনীয়তা নেই।
পৌরসভার প্রধান ‘মেয়র’ যেখানে দাপ্তরিক কাঠামোয় নিজেই ‘প্রধান নির্বাহী’, সেখানে একই কাঠামোয় তার বর্তমানে অধীন ‘প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা’ পদের ধারণা অস্বাভাবিক ও অমূলক।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪০৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ