ইসরায়েল-হামাসের যুদ্ধবিরতিই এক প্রকার পতনের শুরুয়াৎ ছিল নেতানিয়াহুর জন্য। তবে বড়সড় পরিবর্তন চোখে আসে এবারের যুদ্ধে হামাসের প্রতিরোধে। হামাসের প্রতিরোধক্ষমতা ধ্বংসের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভক্তির বীজ বুনে দিয়ে, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লেবাননকে রাজপথে নামানো এবং আসাদ সরকার হটানো ছিল নেতানিয়াহুর লক্ষ্য যদিও একটিতেও সফল হয়নি ইসরায়েল। বরং বদলে গেছে পাশার দান। যুদ্ধের আগে ফিলিস্তিনিরা ছিল বহুভাবে বিভক্ত। কিন্তু এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইসরায়েলি আরবেরা। গাজা থেকে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে হামাসের যোদ্ধারা। এমনকি ইসরায়েলের এক-পঞ্চমাংশ আরব নাগরিক তাদের ফিলিস্তিনি পরিচয় নিয়ে রাস্তায় সংঘর্ষে জড়ায় উগ্র ও দাঙ্গাবাজ ইহুদিবাদী ত্রাসের বিরুদ্ধে। মাহমুদ আব্বাসের ইসরায়েলি ঘেঁষা নীতিও সামনে চলে এসেছে। এতে ইসরায়েলপন্থী মাহমুদ আব্বাস আরও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তবে নেতানিয়াহুর পতন, ফিলিস্তিনিদের জন্য সুবিধার হবে কি না বা হলেও কতটা তা নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা আছে।
খুব একটা পার্থক্য দেখছে না ফিলিস্তিনিরা
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইসরায়েলে সরকারে পরিবর্তন এলেও তাতে খুব কমই পার্থক্য দেখছেন ফিলিস্তিনিরা। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জায়গায় অন্য যে বা যিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনিও ঠিক তার পূর্বসূরির মতো একই ডানপন্থী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করবেন, বলে মন্তব্য করেছেন ফিলিস্তিনিরা।
সূত্র মতে, ইসরায়েলে নতুন জোট সরকার গঠনে বিরোধী দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। গত বুধবার বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে টানা আলোচনার পর প্রধান বিরোধী দলের নেতা ইয়ার লাপিড দেশটির প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিনকে এই ঐকমত্যের খবর জানান। তারা শিগগিরই সরকার গঠন করবেন।
এই সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর টানা ১২ বছরের শাসনের অবসান হতে চলছে।
জোটের চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী দল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেট প্রথম দুই বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। বাকি দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হবেন লাপিড। নতুন এই সরকারের শপথ নেয়ার আগে সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যাচাইয়ে দেশটির পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হবে। জোট যদি ১২০ আসনের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তাহলে নতুন করে নির্বাচন হবে।
কে এই বেনেট?
ইসরায়েলের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী বেনেট একসময়ের প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। ডানপন্থী, উগ্র ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের রাজনীতিতে তার আবির্ভাব ঘটে। ৪৯ বছর বয়সী বেনেট তার রাজনীতির পুরো সময়ে ডানপন্থী ভোটারদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
বেনেট একসময় নেতানিয়াহুর দল ও সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এখন ইয়েমিনা পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই দল অধিকৃত পশ্চিম তীরের একাংশকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছে।
বেনেট ইসরায়েলের স্পেশাল ফোর্সের সাবেক কমান্ডো। অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের মূল সংগঠনের প্রধান ছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনি বিরোধী উগ্র ও বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য বেনেট আলোচিত-সমালোচিত।
গতকাল বৃহস্পতিবারও তিনি সংঘাতের জন্য ফিলিস্তিনিদেরই বেশি দোষ দেন। বেনেটের সবশেষ এই বক্তব্য প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সংগঠন পিএলওর প্রতিনিধি বাসেম আল-সালহি বলেন, নেতানিয়াহুর চেয়ে বেনেট মোটেই কম উগ্র নন। তিনি সম্ভাব্য সরকারে কতটা কট্টর হবেন, সেটিই এখন দেখার।
নতুন সরকার নিয়ে কী ভাবছে গাজা?
গাজার সরকারি কর্মকর্তা আহমেদ রেজিক বলেন, এক ইসরায়েলি নেতা থেকে অপর ইসরায়েলি নেতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা তাদের দেশের ক্ষেত্রে ভালো বা খারাপ হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি যখন ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে আসে, তখন তারা সবাই খারাপ। তারা সবাই ফিলিস্তিনিদের অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানান। তারা ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড দিতে অস্বীকার করেন।
গাজা নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠন হামাস বলেছে, ইসরায়েলে কে ক্ষমতায় এল, আর কে গেল, তাতে কোনো পার্থক্য আসবে না।
হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেন, ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ইতিহাসে ইসরায়েলের অনেকগুলো সরকারই দেখেছেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের কথা এলেই তারা সবাই বৈরী হয়ে যায়। তাদের সব সরকারেরই বৈরী সম্প্রসারণবাদের নীতি দেখা গেছে।
নতুন সরকার নিয়ে নেতানিয়াহুর হুঁশিয়ারি
এদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি জানিয়ে বলেছেন, তাকে সরানোর জন্য প্রস্তাবিত ঐক্য সরকার দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। তিনি ডানপন্থী রাজনীতিকদের আহ্বান জানিয়েছেন এই জোট সরকারকে সমর্থন না করার জন্য।
নেতানিয়াহু বলেন, বাম ঘরানার সরকার গঠন করবেন না। এমন সরকার ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের জন্য একটি হুমকি। বামপন্থী নেতাদের উল্লেখ করে তিনি ইঙ্গিত দেন, এর ফলে ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা দুর্বল হতে পারে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ইসরায়েলের প্রতিরোধ সামর্থ্যে এর প্রভাব কেমন হবে? আমরা শত্রুদের কীভাবে বিবেচনা করবো? ইরান ও গাজা ইস্যুতে তারা কী বলবে?
নেতানিয়াহু অভিযোগ করেন, বেনেট জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন। এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনেটের সমালোচনা করে বলেন, তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হতে চাওয়া ছাড়া আর কিছুর পরোয়া করেন না।
বিশ্বব্যাপী বাড়ছে ইসরায়েল বিরোধিতা
এবার হামাস সফল হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে শত বছর এগোনো ইসরায়েলি সমরযন্ত্রকে পিছু হটতে বাধ্য করতে। পাশাপাশি তাদের এই প্রতিরোধ অধিকৃত ফিলিস্তিনসহ, ইসরায়েল, লেবানন ও জর্ডানের ফিলিস্তিনিদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। তারা দেখাতে পেরেছে তারা সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাসী হলো ইসরায়েল।
বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে ইসরায়েল বিরোধী যে বিক্ষোভ দেখা গেছে, তাও ছিল অভূতপূর্ব। বয়কট ইসরায়েল আন্দোলন আরও চাঙা হয়েছে। সম্প্রতি ৬০০ শিল্পী ইসরায়েলে অনুষ্ঠান করা বয়কট করেছেন। আয়ারল্যান্ড ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক বাতিল করে রাষ্ট্রটিকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছে। বাংলাদেশিদের পাসপোর্টে ইসরায়েল সফরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া দেশে-বিদেশে সমালোচিত হচ্ছে।
বাইডেনসহ ন্যাটো নেতারা জনমতের চাপে ইসরায়েল-নীতি সংশোধন করতে বসেছেন। ইসরায়েলিরা আরও বেশি ডানপন্থী হলেও আমেরিকান ইহুদিরা বামে সরছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট এমপিদের মধ্যেও ইসরায়েলি দখলদারি বিরোধিতা আগের চাইতে বেশি বলে জানাচ্ছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও পিউ রিসার্চের জরিপ।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬৩৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ