স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনিয়ম দুর্নীতি ও ছাত্রী যৌন হয়রানির মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এর খুব অল্প সংখ্যকই সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। আজ তেমনি দুটি খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বেতিল স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ আখতারুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক শান্তনু বিশ্বাস লিংকনের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।
দুর্নীতির দায়ে কলেজ অধ্যক্ষকে বরখাস্ত
অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলাধীন বেতিল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আখতারুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একইসাথে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমানকে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
আজ শুক্রবার দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চৌহালী বেতিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ পদে আখতারুজ্জামান যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে যুক্ত হন। বিশেষ করে স্কুল অ্যান্ড কলেজের খরচের নামে ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে বিপুল অংকের অর্থ আত্মসাৎ করেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের সাথে তার অশোভনীয় আচরণ এলাকায় ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ করে ম্যানেজিং কমিটি। পরে বিধি মোতাবেক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির রেজুলেশনে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট অডিট কমিটি গঠন করে গর্ভনিং বডি। ২৩ থেকে ২৬ মে অডিট কার্যক্রম চলে। এতে অধ্যক্ষ আখতারুজ্জামান বিদ্যালয় থেকে ২০ লাখ ১১ হাজার ৪১২ টাকা ও কলেজ শিক্ষকদের বেতন বাবদ এক লাখ ৩১ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে।
অডিট কমিটির আহ্বায়ক ও প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম জানান, তদন্তে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এ দিকে ম্যানেজিং কমিটির পক্ষ থেকে অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে তিনবার চিঠি ইস্যুসহ তার সাথে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কর্ণপাত করেননি এতে। চিঠিরও কোনো উত্তর দেননি। পরে বিধি মোতাবেক বুধবার ম্যানেজিং কমিটির সভায় সকলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক অধ্যক্ষ আখতারুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
এ বিষয়ে বেতিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শেখ আবদুস ছালাম বলেন, অর্থ আত্মসাৎ করে অধ্যক্ষ প্রতিষ্ঠানের সমস্ত চাবি নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। এতে করোনাকালীন অনলাইন ক্লাসসহ দাফতরিক কার্যক্রম বিঘ্ন হচ্ছে। তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া অফিস কক্ষের চাবিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তবে অধ্যক্ষ আখতারুজ্জামান বলেন, সাময়িক বরখাস্তের বিয়য়ে শুনেছি। কিন্তু আমি ১ টাকারও অনিয়ম বা দুর্নীতি করিনি। আমি নতুন করে তদন্ত চাইবো।
এ ব্যাপারে জানতে চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফসানা ইয়াসমিন জানান, অভিযোগের বিষয়ে মৌখিক ভাবে জেনেছি। সাময়িক বরখাস্তের কপি এখন হাতে পাইনি কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পেরেছি।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) স্থাপত্য বিভাগের খণ্ডকালীন এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন বিভাগটির এক ছাত্রী।
তবে অভিযোগ তদন্তের মুহূর্তে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন অভিযুক্ত শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের প্রধান সহকারী অধ্যাপক মানসুরা খানম গণমাধ্যমকে বিয়ষটি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘একজন খণ্ডকালীন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আমাদের এক ছাত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। বিষয়টির সত্যতা যাচাই চলছে।’
জানা যায়, ইদের ছুটি শেষে গত ২৩ মে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে স্থাপত্য বিভাগের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ওই বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক শান্তনু বিশ্বাস লিংকনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে অসৌজন্যমূলক বার্তা, ছবি এবং কথা পাঠানোর বিষয়টি উঠে এসেছে। তবে এরই মধ্যে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন শিক্ষক শান্তনু বিশ্বাস লিংকন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘২ জুন স্থাপত্য বিভাগের এক খণ্ডকালীন শিক্ষক ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রাজিউর রহমান বলেন, যেহেতু ওই শিক্ষক চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন তাই অভিযোগের সত্যতা পেলেও সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। আমরা ভুক্তভোগী ছাত্রীকে ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারি।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা যখন অনিয়ম দুর্নীতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজেদের গোলা ভরেন, তখন সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার কোনো পরিবেশ থাকে না। শিক্ষকেরা যেমন অনৈতিক ছাত্রদের মাঝে তেমনি নৈতিকতার বীজ বুনে দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা।
তারা মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষকদের স্বচ্ছতা আগে জরুরি। কিন্তু দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যেভাবে অনিয়ম আর দুর্নীতির খবর আসে, এতে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। এবিষয়ে সরকারের প্রত্যক্ষ নজরদারির সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান তারা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মান ক্রমশ হ্রাস পাওয়ার সাথে নৈতিকতার মানও ক্রমশ নিম্নগতিতে। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ আসে। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের খবরও আসে যা অত্যন্ত বিপজ্জনক এক বার্তা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ যেমন একদিকে নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে বাড়ছে নৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধ। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নারীদের জন্যও নিরাপদ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীর যৌন হয়রানি একদিকে যেমন লজ্জার অন্যদিকে ভয়াবহ এক বার্তাও বটে। শিক্ষকদের থেকেও ছাত্রীরা নিরাপদ নয়, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানান তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকদের কেবল চাকরি থেকে বরখাস্ত নয়, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষকদের যৌন লালসার শিকার হয়ে ছাত্রীরা এখন বিদ্যালয়ে পা মাড়াতে ভয় পায়। শিক্ষকদের সাথে ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক সম্পর্ক ব্যাহত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের এমন যৌন লালসার কারণে একদিকে যেমন শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে নারীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহে ভাটা পড়ছে বলে মনে করেন তারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিষ্ঠানে সবধরনের যৌন হয়রানি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ