সুমিত রায়
যেকোন শাসক গোষ্ঠীকে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদেরকে পকেটে রাখার দরকার হয়, কেননা জনমনকে নিয়ন্ত্রণে নিতে গেলে এদের দরকার হয়। এদেরকে অর্থায়ন করার মাধ্যমে শোষক শ্রেণীর পক্ষে জনমত সৃষ্টির করার প্রয়োজন হয়, কেননা সেটা শোষক শ্রেণীর পক্ষে আনুগত্যের পুনরুৎপাদন করে যা ক্ষমতাসম্পর্কের উৎপাদনের জন্য জরুরি।
আজকের আলোচনা বাংলায় কলোনিয়াল পিরিয়ড বা ব্রিটিশ শাসনামলে শাসক-বুদ্ধিজীবী সম্পর্ক নিয়ে। ক্ষমতা দখল করা তুলনামূলকভাবে সহজ ব্যাপার শাসন করার চেয়ে, কলোনিয়াল পিরিয়ডে তো বটেই যেখানে উন্নত স্ট্র্যাটেজিকাল ওয়ারফেয়ারের মাধ্যমে যেকোন ট্রেডিশনাল সমরসজ্জায় সজ্জিত বাহিনীকেই পরাজিত করা সম্ভব। কিন্তু সেই স্ট্র্যাটেজি দিয়ে তো রাষ্ট্র চলে না। কলোনি প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে সম্পূর্ণ নতুন একটা রাষ্ট্রে, স্থানীয় কোন ক্লাসের সাহচর্য ছাড়া শাসন করা সম্ভব হত না।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে ইন্টেলেকচুয়ালদের পকেটে রাখতে হয়েছে যাতে তারা মাস পিপলের মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মত কোন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রোমান্টিসিজম প্রোডিউস করে আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারকে জাস্টিফিকেশন দিতে পারে ও বিরোধী বিএনপি-জামাতের ইসলামিজম, তাদের ন্যাশনালিজমের বিরোধিতা করতে পারে। এর বিনিময়ে সরকার সেই দেশের রিগ্রেসিভ শক্তির হাত থেকে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের রক্ষা করার সুবিধা দেয়, কিন্তু তার বিনিময়ে তারা বুদ্ধিজীবীদের থেকে নেয় অন্ধ আনুগত্য। শাসকদের সাথে প্রগতিশীল বা ইন্টেলেকচুয়ালদের মধ্যে এমন চুক্তিমূলক সম্পর্ক থাকে। বাংলার কলোনিয়াল পিরিয়ডে এমন কিছু ছিল কিনা ভেবে দেখার অবকাশ আছে।
তবে হ্যাঁ, ইন্টেলেকচুয়ালরা কেবল কেবল সরকারের পকেটস্থ থাকে না, ইন্টেলেকচুয়ালদের এন্টিস্টেট বা অ্যানার্কিস্ট অবস্থানও থাকে। কোন শাসক দলের হাতেই এতটা রিসোর্স থাকার কথা নয় যা দিয়ে তারা সকল বুদ্ধিবৃত্তিকে কিনে নেবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা পড়াশুনার সুযোগ পায় তারা শোষক দল আর তাদের ইন্টেলেকচুয়ালদের অপকর্ম টের পায় আর তাদের বিরুদ্ধে লেখালিখিও শুরু করে। রাষ্ট্রকে এদের দমন করার জন্য অনেক ফান্ডিং করতে হয়, পেইড ইন্টেলেকচুয়াল তৈরি করতে হয়, কিন্তু সবসময় এই এন্টিস্টেট আদর্শ নিয়ে তৈরি হওয়া ইন্টেলেকচুয়ালরা তৈরি হতে পারে আর তা নিয়ে কনফ্লিক্টও চলতে পারে৷
কলোনিয়াল পিরিয়ডের ক্ষেত্রে একটা অন্যতম সমস্যা হচ্ছে এই সময়ে এই এন্টিস্টেট ইন্টেলেকচুয়ালরা সিভিল রাইটের পক্ষে এইসব প্রগতিশীল কাজ করতে পারেনা, কারণ তাদেরকে কলোনিয়ালদের বিরুদ্ধেই থাকতে হয়। যত প্রকার প্রগতিশীল কাজ আছে সব হয় শাসক পক্ষের ইন্টেলেকচুয়াল আর সমাজসংস্কারকদের দ্বারা। এক্ষেত্রে প্রগতির পেছনে অবদান শাসকের স্বার্থসিদ্ধির জন্য না শাসকপক্ষের ইন্টেলেকচুয়ালদের মহৎ ইচ্ছায় সেই আনসারটেইন্টি এখানে অন্তর্নিহিত।
এখন প্রশ্ন আসবে জনতার শাসনের চেয়ে অধিকতর প্রগতিশীল আর কী হতে পারে? প্রশ্নটা ভ্যালিড। কিন্তু তা সেক্ষেত্রেই যখন রাষ্ট্রে ইতিমধ্যে আধুনিক ও সিভিল রাইটের অস্তিত্ব স্বীকার করা গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়েছে। কেবল এইসময়ই কোন গোড়া ধার্মিক অধ্যুসিত রাষ্ট্রে যেকোন রকম প্রগতিশীল সেক্যুলার স্বৈরাচারী শাসনের থেকে জনতার শাসন অধিকতর প্রগতিশীল হতে পারে কেননা সেই জনতার শাসন জনগণের সেই সব সিভিল রাইটের প্রতিশ্রুতি দান করে যা স্বৈরাচার লিটারালি হরণ করে নেয়। সব মিলে কলোনিয়াল পিরিয়ডে বাংলায় নবজাগরণ তাদের হাত দিয়েই আসে যারা ব্রিটিশ শাসক ও শোষকদের অনুগত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী হিসেবে কাজ করেছে।
একজন ইন্টেলেকচুয়ালের দার্শনিক চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত প্রভাবগুলো থাকতে পারে –
১) প্রভাব থাকে তার পূর্বের ইন্টেলেকচুয়ালদের কাজ
২) সাধারণ জনগণের ধর্ম ও লোকায়েত বিশ্বাস
৩) সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ
৪) সমকালীন বহির্বিশ্বের দার্শনিক চিন্তা-ঐতিহ্য
সমকালীন বহির্বিশ্বের দার্শনিক চিন্তা-ঐতিহ্য সবসময়ই একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, বাইরে থেকে চিন্তাভাবনা ধার নেয়াতে কোন লজ্জাও নেই। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার উদ্ভব হয় গ্রিক দার্শনিক থেলিসের হাত ধরে। কিন্তু সেটা হত না যদি না ব্যাবিলন থেকে উন্নত জ্যোতিঃশাস্ত্রীয় ধারণাগুলো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে গ্রিসে প্রবেশ না করত। একইভাবে পিথাগোরিয়ানদের হাতে আধুনিক জ্যামিতিরও উদ্ভব হত না যদি না মিশর থেকে আধুনিক পরিমাপন পদ্ধতি একইভাবে গ্রিসে প্রবেশ না করত। ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয় ইতালির ফ্লোরেন্সে। কিন্তু এই আইডিয়া ফ্লোরেন্সবাসীর মধ্য থেকে আসেনি। এটা এসেছিল প্রথমত তুর্কিদের ঠেঙ্গানি খাওয়া গ্রিক পণ্ডিতদের থেকে, দ্বিতীয়ত, মুসলিম স্পেইনের ইসলামিক গোল্ডেন এজের দার্শনিকদের দর্শন থেকে যারা প্রাচীন গ্রিক দর্শনগুলোকে গ্রহণ করেছিল। এই আইডিয়াগুলো নিয়ে প্রথমে ইতালিতে, পরে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড সব ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে আধুনিকতা আসতে থাকে। এদিকে সেই গ্রিসই পিছিয়ে থাকে। যাই হোক, বহির্বিশ্ব থেকে ধারণা আমদানি করাই যায়, কিন্তু কতটা নিজে থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে, আর কতটা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই বিতর্ক এখানে থেকেই যায়, বিশেষ করে যখন কলোনিয়াল পিরিয়ডের আলোচনা আসে তখন।
রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ যা ইন্টেলেকচুয়ালদের চিন্তা-ঐতিহ্যের বিকাশে অন্যতম সোশিও-ইকোনমিক ফ্যাক্টর তৈরি করে। ভারতীয় উপমহাদেশে সিভিল রাইটের বিকাশের জন্য তদসম্পর্কিত রাষ্ট্র দর্শন ও নীতি দর্শনের প্রয়োজন। ইউরোপ যে রাষ্ট্রদর্শনের বিকাশ ঘটায় তাতে ছিল পুরোহিততন্ত্রের বাড়াবাড়িতে রাজার ক্ষমতালোপ, বাণিজ্যিক শ্রেণীর সৃষ্টি। তারা যে নীতিদর্শনের সৃষ্টি করে তার পেছনে ছিল পুরোহিততন্ত্রের কারণে চার্চের দ্বারা মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যকার দূরত্ব ও দুর্নীতির বৃদ্ধি। এখান থেকেই রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করা ও পুরোহিততন্ত্রকে খর্ব করে ধর্মালয়মুখিতার বদলে মানবমুখিতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ধর্মসংস্কারের ধারণা আসে। এগুলো পরবর্তীতে সিভিল রাইট বিকাশে প্ররোচিত করে। কিন্তু এগুলোও সম্ভব হতনা যদি ইন্টেলেকচুয়ালদের দ্বারা যথেষ্ট পলিটিকাল পাওয়ার ওয়ালা লোকেরা ইনফ্লুয়েন্সড না হত, আর ৩০ বছরের যুদ্ধ, ইংলিশ সিভিল ওয়ার, ফ্রেঞ্চ রেভোল্যুশনে সেইসব সিভিল রাইটের পক্ষের পলিটিকাল পাওয়ারগুলো জয়লাভ না করত।
এখন ভারতবর্ষের অবস্থা কী ছিল? ইন্টেলেকচুয়াল আসে তুলনামূলক স্বচ্ছল ঘর থেকেই কেননা তাদের চিন্তা করার সুযোগ থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায় তখন এলিট ছিল আশরাফ মুসলিম ক্লাস আর বর্ণহিন্দু ক্লাস। এখানে পুরোহিত তন্ত্র ছিল? কড়াকড়িভাবেই ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদ আর ইসলামবাদের নাম নিয়ে। এখানে কি বাণিজ্যিক ক্লাসের বিকাশ ঘটে? অবশ্যই ঘটে, বাংলা তো পৃথিবীর সমৃদ্ধতম অঞ্চলগুলোর একটি ছিল। তাহলে সিভিল রাইটের বিকাশের শর্তগুলো তৈরি হল না কেন, যেখানে রাজা বাণিজ্যিক শ্রেণীর সহায়তায় পুরোহিততন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করবে এবং ধর্মসংস্কারকগণ পুরোহিততন্ত্রকে খর্ব করে মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যকার সরাসরি সম্পর্ক সৃষ্টি করবে?
হয়নি কারণ ভারতবর্ষ কনফ্লিক্টিং অবস্থায় ছিল। এখানে রাজাসনে থাকা মুসলিম শাসকদের প্রজাদের বড় অংশ হিন্দু ছিল। বিদ্রোহের সমূহ সম্ভাবনা ছিল, হয়েছিলও, আর হিন্দু শাসকদের মধ্যেও বিধর্মী রাজাদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। এই কনফ্লিক্টের অবস্থায় রাজারা ধর্মের বিরুদ্ধে যেতে চায় না বরং ধর্মকে আকড়ে ধরে। ইন্টেলেকচুয়ালরা যদি রাষ্ট্র ও ধর্মকে আলাদা করার চিন্তা করেও তাহলে তা পলিটিকাল পাওয়ারগুলোকে ইনফ্লুয়েন্স করবে না। একইভাবে ধর্মসংস্কারের মাধ্যমে মানুষ ও ঈশ্বরের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা এখানে হয়েছিল, গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের মত ভাবান্দোলন হয়েছিল, কিন্তু তাও এই কনফ্লিক্টিং সিচুয়েশনে ফ্লোরিশিং ব্রাহ্মণ্যবাদের কারণে ভেস্তে যায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদ ব্রাহ্মণ্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। এইসব কারণে ভারতবর্ষে সিভিল রাইটের বিকাশ সম্ভব হয়না। কেবল মাত্র তখনই তার ক্ষেত্র প্রস্তুত সম্ভব হত যখন এই কনফ্লিক্ট হ্রাস হত। তা কখন হত, কিভাবে হত বা আদৌ হত কিনা তা আমরা জানিনা, এমনকি জানা সম্ভব কিনা তাও জানিনা, কেননা ভারতবর্ষ এরপর কলোনিয়াল শাসনে প্রবেশ করে।
এইরকম একটা জায়গায় তুলনামূলকভাবে বিকশিত জাতির শাসন এলে কী হবে? এখানে প্রথমেই কলোনিয়াল শাসক তাদের আনুগত্য ক্লাসের সন্ধান করবে, তারা আশরাফ মুসলিম ও বর্ণ হিন্দু দুই ক্লাসকেই অনুগত করার চেষ্টা করবে, কিন্তু আশরাফ মুসলিম আনুগত্য দেখাবে না কেননা মুসলিম শাসকদের পতনের ফলে তারা তাদের স্ট্যাটাস হারিয়েছে, আর আনুগত্য প্রকাশে তাদের স্ট্যাটাসের উন্নয়ন ঘটবে না। বর্ণ হিন্দু ক্লাস আনুগত্য দেখাবে, কেননা মুসলিম শাসনামলে তারা যে স্ট্যাটাসে ছিল এই ক্লাসে তাদের স্ট্যাটাস তেমনি থাকছে, কিন্তু হাতে আসছে অধিকতর সম্পদ, সেই সাথে এর আগে তারা আশরাফ মুসলিম ক্লাসের সাথে যে কনফ্লিক্টিং পজিশনে ছিল এখানে তারা পাচ্ছে সেই ক্লাসের উপরে ওঠার সুযোগ। আগে এদেরকে ফারসি শিখে আনুগত্য প্রকাশ করতে হত, এখন ইংরেজি শিখে করতে হবে, ফারসি ভাষায় কথা বলা আশরাফ মুসলিম আর ইংরেজিতে কথা বলা ব্রিটিশদেরকে এরা একই ক্যাটাগরিতে ফেলতে পারে যাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা দরকার।
এই জায়গায় অর্থসম্পত্তির অধিকারী হয়ে বর্ণহিন্দু ক্লাসের কিছু সংখ্যক মানুষ বহির্বিশ্বের সমসাময়িক চিন্তা-ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইন্টেলেকচুয়াল হবে। ফলে তাদের মধ্যে রিগ্রেসিভ সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাবে। অন্যদিকে শাসকদের দরকার হবে অনুগত ক্লাসের যারা পাশ্চাত্য চিন্তা-ঐতিহ্যকে সমাজের রিগ্রেসিভ চিন্তা-ঐতিহ্যের চেয়ে শ্রেয় মনে করছে, এটা ঠিক আর্থিক স্বচ্ছলতা এলে মানুষ লিবারাল আচরণ করা শুরু করে, তখন অনেকে সিভিল রাইটকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা শুরু করবে। এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগাবে শাসক শ্রেণী। শাসক শ্রেণী অনুগত ক্লাস সৃষ্টির জন্য সমাজ সংস্কারকে প্রমোট করবে, সিভিল রাইট এর আইন প্রণয়ন করার চেষ্টা করবে। প্রচুর টাকা ঢালবে, নিজেদের অনুগত ক্লাসকে পাশ্চাত্য ভাবধারায় শিক্ষিত করার মাধ্যমে নিজেদের শাসনকে জাস্টিফাই ও স্ট্যাবল করবে, জনমত গঠন করতে চাইবে নিজেদের পক্ষের এই ইন্টেলেকচুয়ালদের দিয়ে। বিনিময়ে এইসব প্রগতিশীল ইন্টেলেকচুয়ালদের দান করবে রিগ্রেসিভদের থেকে প্রোটেকশন। এই সময়েই তারা সমাজ সংস্কারও করার চেষ্টা করবে, বিভিন্ন সিভিল রাইট সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করবে। এর উদ্দেশ্যও সেই পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুগত ক্লাস তৈরি, যারা তাদের সহায়তা করবে, তাদের কলোনিয়াল এক্টিভিটিকে সমর্থন করবে। বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের মত সমাজ সংস্কারগুলো বাংলায় পাশ্চাত্য উদার সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার অংশ হতে পারে। উদ্দেশ্য হতে পারে পাশ্চাত্য ভাবাদর্শের সমাজ তৈরি করা। এছাড়া ইংরেজদের হোয়াইট সুপ্রিমেসিজম, সাইন্টিফিক রেসিজমের উদ্ভব হচ্ছে, ব্রিটিশরা সোশ্যাল ইভোল্যুশনিজমের ধারণায় তখন লিডে ছিল। তারা তত্ত্ব দেয় ট্রেডিশনাল সমাজগুলোকে হয় ধ্বংস হতে হবে, নয় তাদেরকে কলোনিয়ালিজমের দ্বারা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে এডপ্ট করে নিতে হবে। ব্রিটিশদের দ্বারা সেই সময়ের সমাজ সংস্কার এই দর্শনের দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে। ( এইসব সংস্কারে ইন্টেলেকচুয়ালদের অবদানকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছিনা। কার কতটা অবদান ছিল তার জন্য ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।)
এই সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে যে সিভিল রাইটের বিকাশ ঘটবে তা রাজনীতি-নিরপেক্ষভাবে ভাল, সিভিল রাইট, দার্শনিক চিন্তা-ঐতিহ্যের বিকাশ ভাল নাকি খারাপ তাতে এখানে কিছু আসে যায় না, এগুলো সবসময়ই ভাল, এবং এগুলো সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়, বিধবা বিবাহের প্রবর্তন উচিৎ ছিল, সতীদাহ রদ করাও জরুরি ছিল। তবে এখানে আলোচ্য হল সেইসব শাসক শ্রেণীর পক্ষের ইন্টেলেকচুয়ালদের অবদান কতটা। আগেই বলেছি, কলোনিয়াল শাসনের আগে সিভিল রাইট সম্পর্কিত দার্শনিক বিকাশের ক্ষেত্র ছিলনা, তা আসে কলোনিয়ালদের আগমনের পর, যেখানে সিভিল রাইটের বিকাশে শাসক শ্রেণীর স্বার্থ জড়িত ছিল। এখানে সিভিল রাইটের দর্শন ও আইনের বিকাশে ইন্টেলেকচুয়ালদের ভূমিকা কতটা আর শাসক শ্রেণীর ভূমিকা কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এর উত্তর পেতে হলে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে সেই সোশিও-ইকোনমিক-পলিটিকাল ফ্যাক্টরগুলোকে, আবার বিবেচনা করতে হবে এখানে শাসক-বুদ্ধিজীবীর মিথোস্ক্রিয়া বিদ্যমান থাকায় আলাদা আলাদাভাবে ভূমিকা নির্ণয়ের আনসারটেইনটিকেও, যদি নির্ণয় করা না যায় তাহলে বলতে হবে এটা অনির্ণেয়।
এবার প্রশ্ন আসবে কৃতিত্ব ও দায়ভারের প্রসঙ্গে। যাদের কারণে ভারতবর্ষের সিভিল রাইটের (কিছুটা হলেও) উন্নয়ন হল তাদের এই সিভিল রাইটের উন্নয়নের জন্য কৃতিত্ব দেয়া যায়? এটা একটা দার্শনিক প্রশ্ন তাই আমাকে দর্শনে যেতে হবে।
এক্ষেত্রে দুটো অবস্থানের কথা বলি-
(১) কর্তার ভাল ইন্টেনশন ছিল কি ছিল না তাতে কিছু আসে যায়না, কর্তা কর্মের কারণ হয়েছেন তাই তার কৃতিত্ব বা দায় নিতে হবে।
(২) কর্তার যদি উপকারের ইন্টেনশন থাকে তাহলেই তিনি কৃতিত্ব নেবেন।
মোরাল ফিলোসফি বা নীতি দর্শন এটা নিয়ে আলোচনা করে। এটা ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। মোরাল ফিলোসফি অনুসারে, এই কৃতিত্ব বা দায়ভারকে বলে মোরাল রেসপন্সিবিলিটি। মোরাল রেসপন্সিবিলিটি তখন আসে যখন কোন মোরাল এজেন্ট বা নৈতিক কর্তা কোন সিচুয়েশনে তার ইন্টেনশন অনুযায়ী কোন কার্য চসম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেন। এই ইন্টেনশন আসে ফ্রি উইল থেকে। ১ নং পয়েন্টে ইনটেনশনে কিছু আসে যায় না, এখানে ফ্রি উইলের ভূমিকা নেই, এই কার্য হয়েছে তাই কৃতিত্ব পাবে। ইন্টেনশন নেই বলে এখানে মোরাল রেস্পন্সিবিলিটির কিছু নেই, তাই কৃতিত্বেরও কিছু নেই। ১ নং পয়েন্ট তাই পরিত্যাজ্য হবে। ফ্রি উইলকে অস্বীকার করা হার্ড ডিটারমিনিজমকে এটা মেনে নেয়, আবার মোরাল রেসপন্সিবিলিটি আরোপ করতে চায় যার জন্য ফ্রি উইল দরকার, এই অবস্থান তাই সাংঘর্ষিক।
২য় পয়েন্ট নিয়ে কথা বলার অবকাশ আছে। এখানে কৃতিত্ব পাবার জন্য সমাজের ভাল করার ইন্টেনশন থাকতে হবে। কিন্তু এর ভিত্তিতেও মোরাল রেসপন্সিবিলিটি নির্ধারণ সম্পর্কিত দার্শনিক সমস্যা রয়েছে।
একজন ব্যক্তি ডিটারমিনিজম বা নিয়ন্ত্রণবাদ সম্পর্কে ও ফ্রি উইল সম্পর্কে কী অবস্থানে থাকেন তার উপর নির্ভর করবে মোরাল রেসপন্সিবিলিটি সম্পর্কে তার অবস্থান কী হবে। এখানে ডিটারমিনিজম কী আর ফ্রি উইল কী তা একটু সংক্ষেপে বলে রাখি। ডিটারমিনিজম অনেক রকমের আছে এখানে প্রাসঙ্গিক ডিটারমিনিজম হল কজাল ডিটারমিনিজম। কজাল ডিটারমিনিজম হল সেই অবস্থান যা মনে করে মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনা কার্যকারণ সম্পর্কিত, সব ঘটনাপ্রবাহ ঠিক করে দেয় তার পূর্ববর্তী কারণগুলো, আর এর মধ্যে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘটনাও অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ মানুষ কি চিন্তা করবে, কি সিদ্ধান্ত নেবে তা নির্ধারিত হয় তার আশেপাশের পরিবেশগত (সোশিও-ইকোনমিক ফ্যাক্টর), জিনগত ফ্যাক্টরগুলোর দ্বারা। তার চিন্তাভাবনা এই কার্যকারণের নিয়মের বাইরে নয়, এমনকি তিনি যে মনে করছেন তার স্বাধীন ইচ্ছা বলে ব্যাপার আছে, তিনি তার নিজের ভাবনা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তাও আসলে কারণসমূহের দ্বারাই প্রভাবিত। ফাটালিজম বা ভাগ্যবাদ, থিওলজিকাল ডিটারমিনিজম বা ঈশ্বর সব নিয়ন্ত্রণ করে, এগুলোও ডিটারমিনিজম, কিন্তু কজাল ডিটারমিনিজম এদের থেকে আলাদা। এদিকে ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছা হল স্বাধীনভাবে চিন্তা ভাবনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সর্বপরি ইচ্ছা করার ক্ষমতা। এক্ষেত্রে চারটি অবস্থান দেখা যায় –
(১) হার্ড ডিটারমিনিজম – ডিটারমিনিজম বা নিয়ন্ত্রণবাদ সত্য, ফ্রি উইল বলতে কিছু নেই, আমরা যে মনে করি ফ্রি উইল আছে, তা আসলে ডিটারমিনিজমের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে তৈরি হওয়া স্বাধীন ইচ্ছার অবভাস।
(২) কম্প্যাটিবিলিজম – নিয়ন্ত্রণবাদ সত্য, কিন্তু ফ্রি উইলও আছে। এক্ষেত্রে পৃথিবী ডিটারমিনিস্টিক হলেও আমাদের বিভিন্ন অপশন গ্রহন করার কিছু স্কোপ থাকে যা নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের ইচ্ছার দ্বারাই।
(৩) হার্ড ইনকম্প্যাটিবিলিজম – ডিটারমিনিজম মিথ্যা, ফ্রি উইল বলতেও কিছু নেই। কিছুই নিয়ন্ত্রিত নয়।
(৪) লিবারটারিয়ানিজম – ডিটারমিনিজম মিথ্যা, ফ্রি উইল আছে। ফ্রি উইল দিয়েই মানব সমাজের সব কিছু চলে।
এখানে যে সব অবস্থান ফ্রি উইলকে স্বীকার করে না, সেসব অবস্থান অনুসারে মোরাল রেসপন্সিবিলিটি বলে কিছু হয়না, এখানে ইন্টেলেকচুয়ালদের কৃতিত্ব বা দায়ভারের ব্যাপারটাই অপ্রয়োজনীয়। অবশ্য মোরাল রেসপন্সিবিলিটি আর লিগাল রেসপন্সিবিলিটি এক নয়। একজন ব্যক্তি অপরাধের জন্য মোরালি রেসপন্সিবল না হলেও লিগালি রেসপন্সিবল হতে পারে। নির্দিষ্ট সোশিও-ইকোনমিক ও জেনেটিক ফ্যাক্টরের জন্য অপরাধী অপরাধ করেছে। তাকে লিগালি রেসপন্সিবল করার অর্থ হল তাকে অপরধের সাথে সম্পর্কিত সোশিও-ইকোনমিক ফ্যাক্টরগু জেনেটিক ফ্যাক্টরের প্রভাব আছে চিহ্নিত করা, এবং কারাগার বা অন্য কোন জায়গায় নিয়ে গিয়ে তার মধ্যে সেইসব ফ্যাক্টরগুলো অপসারণ করা, অপসারণ করা না গেলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাতে সমাজের মঙ্গল হয়।
আধুনিক বিজ্ঞান আমাদেরকে দেখায় কিভাবে মহাবিশ্বের শুরু থেকে, এমনকি কিছু মডেল অনুসারে শুরুর পূর্ব থেকেই জগত কিভাবে কার্য-কারণ নীতির উপর নির্ভরশীল, প্রত্যেকটি বিষয়ের কারণ বা ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করাই বিজ্ঞানের কাজ। এর ফলে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নয়ন কজাল ডিটারমিনিজম বা নিয়ন্ত্রণবাদের অস্তিত্বকেই ইঙ্গিত করছে, আমিও একজন কজাল ডিটারমিনিস্ট। কিন্তু সমস্যা হল ফ্রি উইলের অস্তিত্ব নিয়ে। আগে মনে হত ফ্রি উইল বলতে কিছু নেই, কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু আবিষ্কার এই বিষয়ে যথেষ্ট কনফিউশন সৃষ্টি করেছে। স্টিফেন হকিংও মনে করতেন আমাদের চিন্তা-ভাবনার মত ম্যাক্রো লেভেলের কাজ কর্মে কোয়ান্টাম জগতের ইন্ডিটারমিনেসির কোন প্রভাব থাকা সম্ভব নয়, কিন্তু এখন এই ধারণা এসেছে যে কোয়ান্টাম জগত ক্যাওস থিওরির সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে আমাদের স্নায়ুকোষকে প্রভাবিত করতে পারে, যা আমাদের চিন্তাকেও প্রভাবিত করতে পারে। এদিকে ৩২ গুটির গো বা চাইনিজ দাবার ক্ষেত্রে দেখা যায় কিছু ডিটারমিনিস্টিক রুলের পরেও অসীম সম্ভাবনার মুভ বা চালের অপশন তৈরি হয়, যেখানে গুটির সংখ্যা কমিয়ে দিতে দিতে ৭টি গুটি নিয়ে খেললে খেলাটির চালগুলো আগে থেকেই প্রেডিক্ট করা সম্ভব হয়, বিভিন্ন চাল দিলে কত রকম ভাবে খেলাটি খেলা যায় আর তার ফল কিরকম হবে তা নির্ধারণ করা সম্ভব। এই ব্যাপারগুলো ডিটারমিনিজম সত্য হবার পরও ফ্রি উইলের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে। যদিও আরও প্রশ্ন আসে, এখানে ইনফিনিট সংখ্যক মুভের সৃষ্টি হলে ক্যাওটিক কমপ্লেক্স সিস্টেমে তৈরি হওয়া আপাত র্যান্ডমনেস আসলেই দিয়ে আসলেই ফ্রি উইলের ব্যাখ্যা দেয়া যায় কিনা, এক্ষেত্রেও ফ্রি উইল ডিটারমিনিজমের ঊর্ধ্বে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছেই। আমার অবস্থানও তাই হার্ড ডিটারমিনিজম আর কম্প্যাটিবিলিজমের মধ্যে দোদুল্যমান।
হার্ড ডিটারমিনিস্ট অবস্থানের ক্ষেত্রে এইসব মোরাল রেসপন্সিবিলিটি, দায়ভার নেয়া, কৃতিত্ব নেয়া সব কিছুই অপ্রাসঙ্গিক, যদিও এক্ষেত্রে সমাজের মঙ্গল কিসে হত, কী করলে সমাজের মঙ্গল হবে, কারা অপরাধী আর অপরাধীর শাস্তি কিভাবে দেয়া হবে এই সব আলোচনা করার সুযোগ থাকেই। আর অন্যদিকে কম্প্যাটিবিলিস্ট অবস্থানের ক্ষেত্রে, যেহেতু ফ্রি উইলের অপশন থেকে যায় সেহেতু সেসময়ের বুদ্ধিজীবীদের মোরাল রেস্পন্সিবিলিটির প্রসঙ্গ আসবে। সেক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব, দায়ভারের ক্ষেত্রে ইন্টেনশনের ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। তবে এই অবস্থান ডিটারমিনিজমও স্বীকার করে। এক্ষেত্রে কোন কোন ফ্যাক্টরগুলো এজেন্টের ইন্টেনশন সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে তাকে বিবেচনা করে তাদের মোরাল রেস্পন্সিবিলিটিকে অ্যানালাসিস করতে হবে। সেই সাথে যদি ইন্টেনশন ছিল কি ছিল না, তা নির্ণয় করা যদি ঐতিহাসিক দলিলগুলোর দ্বারা সম্ভব না হয়, তাহলে তাকে উল্লেখ করাই ঠিক হবে।
কেন এই সময়ে নবজাগরণ নিয়ে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করা দরকার ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করা দরকার? এর প্রধান কারণ নবজাগরণ নিয়ে দুই বাংলার লোকেদের মধ্যে বাস করা রোমান্টিসিজম। রোমান্টিসিজম এর অর্থ হতে পারে অতীত নিয়ে গর্ব করে, নিজের পরিচয়ের অংশ মনে করা, কখনও বা সেই অতীতে ফিরে যাবার চেষ্টা করা। সমাজের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি যতই খারাপ হতে থাকে, মানুষের মধ্যে রাগ দুঃখ ক্ষোভ হতাশা ততই বাড়ে। আর এর সাথে বাড়ে আইডেন্টিটির চাহিদা, হাত ধরাধরি করে আসে রোমান্টিসিজমের চাহিদা। কেউ হয় ধর্মীয় অতীত, ধর্মীয় ইতিহাস, ধর্মীয় পুরাণ নিয়ে রোমান্টিক (যেমন ইসলামিক রিভাইভালিস্টরা মুহম্মদের যুগে ফিরে যেতে চায়, হিন্দুত্ববাদীরা চায় রামরাজত্বে ফিরে যেতে), কেউ হয় মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন-মারাঠা সাম্রাহ্য নিয়ে রোমান্টিক, কেউ হয় হুসাইন শাহ-মুঘল-সুলতানি-নবাবি শাসন নিয়ে রোমান্টিক, কেউ হয় “আর্য আক্রমণ” নিয়ে, কেউ আর্য-পূর্ব সমাজ নিয়ে রোমান্টিক, কেউ হয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রোমান্টিক, কেউ হয় নবজাগরণ নিয়ে রোমান্টিক। এইসব রোমান্টিসিজম বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে ইতিহাসের একরকম অবভাস থেকে। একেকটা রোমান্টিসিজম একেকটা পরিচয় গঠন করে, আর তার ফলে তৈরি হয় একেকটা জাতীয়তাবাদ। আমি জাতীয়তাবাদকে সর্বোপরি খারাপ বলছি না এখানে, তবে জাতীয়তাবাদের রোমান্টিক পার্টকে খারাপ বলছি (রোমান্টিসিজম ছাড়াই জাতীয়তাবাদ তৈরি হতে পারে)। এই রোমান্টিসিজম বিভিন্ন রকম প্রিজুডিস (যেমন সাম্প্রদায়িকতা), কনজারভেটিজম, ফ্যাসিজম তৈরি করতে পারে, তাই সাবধান হওয়া জরুরি। আর তাই বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা করে রোমান্টিসিজম ভাঙ্গার চেষ্টা করা উচিৎ। (তবে শ্রদ্ধা করাকে খারাপ বলছি না, নবজাগরণের মনিষীদেরকে শ্রদ্ধা করা যেতেই পারে, তবে শ্রদ্ধার রোমান্টিক পার্টটুকু দমন করা দরকার, অ্যারোমান্টিক শ্রদ্ধাটাই জরুরি।)
এই রোমান্টিসিজমের আরেকটা সুবিধা ইন্টেলেকচুয়াল মহলে দেখা যায়। যেকোন রাষ্ট্রের ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রধান দায়িত্ব জনসম্পৃক্ত হওয়া। সেটার জন্য রিয়ালিজমের চর্চা দরকার। ইন্টেলেকচুয়ালরা যে শিল্প সৃষ্টি করবে তা তৈরি হতে হবে সমকালীন সমস্যাগুলোকে টারগেট করে, আর তা না করে যদি তারা জনসম্পৃক্তহীন হয়ে সেই রোমান্টিসিজম নিয়ে পড়ে থাকে তাহলে তাহলে বলতে গেলে রাষ্ট্রে ফাংশনাল বুদ্ধিজীবী আর থাকেনা। কলোনিয়াল পিরিয়ডের বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের শোষকগোষ্ঠী তাদের নিয়ে কাল্ট অফ পারসোনালিটি তৈরি করে। শাসন করার জন্য শোষক শ্রেণী শোষক ভাবাদর্শ তৈরি করে, নবজাগরণের মনিষীদেরকে পবিত্র হিসেবে উপস্থিত করে যার মাধ্যমে তারা তৈরি করতে চায় সাংস্কৃতিক আধিপত্য। কালচার ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মাধ্যমে পপুলার কালচার হিসেবেও রোমান্টিক চেতনাগুলো ব্যবহার করা হয়। আর পছন্দের রোমান্টিক চেতনা দিয়ে শাসক শ্রেণী তৈরি করে নিজেদের পছন্দের জাতীয় চেতনা।
এই রোমান্টিক চেতনা ভাঙ্গার জন্য রিয়ালিজমের চর্চা জরুরি, বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চা জরুরি। তবে সমাজে যতক্ষণ ক্রাইসিস থাকবে ততক্ষণ রোমান্টিক চাহিদাও থাকবে। একটি বিষয়ে রোমান্টিসিজম ভাংলে আরেকটি বিষয় নিয়ে রোমান্টিক হবে। কিন্তু তবুও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের চর্চা করে যেতে হবে। কারণ তা (১) দুঃখ দূর হলে কাজে লাগবে, (২) দুঃখ দূর করার আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য যে জনসচেতনতা লাগে তা তৈরি করতে (অনেকের মতে ফলস কনশাসনেস ভাংতে) কাজে লাগবে।
আপনার মতামত জানানঃ