ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সব মুসলিম রাষ্ট্রই এখনো জোরালো সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্প্রতি সীমান্ত লাগোয়া মুসলিম দেশগুলো ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য বিস্তারের দিকে যাচ্ছে। ইসরাইলের উন্নতমানের আইটি পণ্য, কম্পিউটার, মেশিনারিজ, প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র নিচ্ছে এসব মুসলিম দেশ।
এদিকে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বিরোধে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট। ফিলিস্তিনিদের স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে একেবারে শুরু থেকেই। অথচ এক দশকের বেশি সময় ধরে ইসরাইলে পণ্য রপ্তানি করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু কীভাবে রপ্তানি হচ্ছে, তা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় কেউ।
ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য
তিনদিক থেকে মুসলিম রাষ্ট্র বেষ্টিত হচ্ছে ইসরাইল। একদিকে রয়েছে মেডিটেরানিয়ান সি বা ভূমধ্যসাগর। স্থল সীমান্ত লাগোয়া দেশগুলো হচ্ছে মিসর, জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন।
ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বর্তমানের প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্ক। ১৯৯৭ সাল থেকে দেশ দুটির মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) চালু হয়। বছরে গড়ে ৫০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি-রপ্তানি করে দেশ দুটি। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৯৮০ সালে মিসরের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ইসরাইলের। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্কও চালু হয়। বর্তমানে দেশ দুটির বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ২৩ কোটি ডলার।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আরব আমিরাতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ইসরাইলের। যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে থাকা দুটি দেশ নিজেদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এরপর থেকেই দুই দেশই রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়। চলাচল শুরু হয় বিমানের। মূলত ইসরাইল থেকে আধুনিক ড্রোন, প্রযুক্তি পণ্য ও সামরিক অস্ত্রের ক্রয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা হয় আরব আমিরাতের।
ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের আনুষ্ঠানিক কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক এখনও গড়ে ওঠেনি। তবে ছোট পরিসরে আমদানি-রপ্তানি চলছে দেশ দুটির মধ্যে। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০ সালেও দুই দেশের মধ্যে দুই লাখ ১৪ হাজার ডলারের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হয়। যদিও দেশ দুটির মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু পর্যটন ও সীমিত কিছু পণ্য বিনিময় করে দেশ দুটি।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতারের সঙ্গে ইসরাইলের কোনো কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই। তারপরও কাতার ইসরাইল থেকে মেশিনারিজ, কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক পণ্য নিয়েছিল কাতার। আবার কাতার থেকে প্লাস্টিক পণ্য নিয়েছিল ইসরাইল। যদিও ২০১২ সালের পর থেকে দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ রয়েছে।
শর্ত অনুযায়ী কাতারের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তার অংশ হিসেবে ভবন ও অসহায় মানুষদের সহায়তা করার বিষয়টি আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই ইসরাইল বেঁকে বসে। কাতারের প্রস্তাবে রাজি হয়নি ইসরাইল। এরপর থেকেই কাতার বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ করে দেয়।
মুসলিম বিশ্বে প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই ইসরাইলের। কিন্তু ২০০৫ সাল থেকে ইসরাইলি পণ্যের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় সৌদি আরব। ইসরাইলি পণ্যের নিষেধাজ্ঞার প্রত্যাহারে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে আবেদন করে দেশটি। এরপরই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যভুক্ত দেশ হওয়ায় সৌদি আরবকে অনুরোধ করা হয়। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে সৌদি আরব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনের সঙ্গে সম্প্রতি সম্পর্ক স্থাপনের দিকে যাচ্ছে ইসরাইল। আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো একসঙ্গে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যপ্রাচ্যের এ চার দেশ ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণে সম্পর্ক শিথিল করছে বলে গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ আলজেরিয়ার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক নেই ইসরাইলের। কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে কিছুটা বাণিজ্য চলছে। তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশ দুটির সঙ্গে বছরে চার মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়।
বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি
ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নীরবে। প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্য রপ্তানি হচ্ছে এবং তা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা দুবাইয়ের মতো তৃতীয় দেশ হয়ে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা পণ্য পাঠিয়ে থাকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে। পণ্যমূল্যও পরিশোধ করা হয় সিঙ্গাপুর বা দুবাই থেকে। ফল লেনদেনটি বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে রপ্তানি হিসেবে গণ্য হয়। আর সিঙ্গাপুর থেকে যে কোম্পানি এই পণ্য আমদানি করে, সেটি মূলত ইসরায়েলের কোনো কোম্পানির শাখা বা প্রতিনিধি অফিস। তারা এই পণ্য সিঙ্গাপুর থেকে মাদার ভেসেলে তুলে দেয় ইসরায়েলের হাইফা বন্দরের উদ্দেশে। বিষয়টি অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, গত প্রায় ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ইসরাইলে রপ্তানি করা হয় চার লাখ ৭৭ হাজার ৮২২ ডলারের পণ্য। এর মধ্যে অন্যতম হলো তৈরি পোশাক। তবে কয়েক বছর ধরে যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ও কুষ্ঠরোগের ভ্যাকসিনও রপ্তানি হচ্ছে দেশটিতে। এছাড়া সামান্য কিছু সবজি, আসবাবপত্র ও মোটরসাইকেলও রপ্তানি করা হয়েছে।
এদিকে ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিনেও সামান্য পরিমাণে পণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। এক দশকে ফিলিস্তিনে রপ্তানি হয় তিন লাখ পাঁচ হাজার ৪৬৩ ডলারের পণ্য; যা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই তৈরি পোশাক। তবে এক বছর সামান্য কিছু সবজি ও আসবাবপত্র রপ্তানি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গণমাধ্যমকে বলেন, পাসপোর্ট থেকে ‘এক্সসেপ্ট ইসরাইল’ তুলে দেয়া হলেও ইসরাইলের সঙ্গে ভবিষ্যতে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা হবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে ইসরাইলে কীভাবে ও কী পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় তা জানা নেই।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে ইসরাইলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল আট হাজার ৪৬২ ডলারের, যার প্রায় পুরোটাই নিট পোশাক। এর মধ্যে রয়েছে জার্সি, ট্রাউজার, পুলওভার, টেবিলওয়ার, কিচেনওয়ার, কার্ডিগান ও অন্যান্য টেক্সটাইল পণ্য। পরের অর্থবছরও প্রায় একই ধরনের পণ্য রপ্তানি হয় দেশটিতে। সে বছর রপ্তানি আয় ছিল ২২ হাজার ৪৩৫ ডলার।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে কিছু খাদ্যপণ্য রপ্তানি হয়। আর ওই বছর রপ্তানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৫৭৭ ডলার। পরের অর্থবছর তৈরি পোশাকের পাশাপাশি কিছু আসবাবও রপ্তানি হয়েছে। ওই অর্থবছর ইসরাইলে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ২৩৬ ডলার। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছর তৈরি পোশাক ও আসবাব ছাড়াও যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ও কুষ্ঠরোগের ভ্যাকসিন রপ্তানি করা হয়। সে বছর রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ২১ হাজার ৫৬৮ ডলার।
২০১৬-১৭ অর্থবছর ভ্যাকসিনের (যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া ও কুষ্ঠরোগ) পাশাপাশি শীতের পোশাক ও ঝাড়বাতি রপ্তানি করা হয়। সে বছর রপ্তানির আয় ছিল রেকর্ড এক লাখ এক হাজার ৯৯৫ ডলার। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর ভ্যাকসিন ও বিভিন্ন আসবাবপত্র রপ্তানি করা হয়। সে বছর রপ্তানি আয় হয় ৮৩ হাজার ৬৮০ ডলার।
২০১৮-১৯ অর্থবছর ইসরাইলে আবারও রেকর্ড এক লাখ ১৮ হাজার ৭০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে বড় অংশই ছিল ভ্যাকসিন। এছাড়া কিছু মোটরসাইকেল ও সামান্য পরিমাণ আসবাবপত্র রপ্তানি হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর ও চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) শুধু ভ্যাকসিন রপ্তানি হয়েছে ইসরাইল। এ দুই বছর রপ্তানি আয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ২৮ হাজার ৬৭ ডলার ও ৪৩ হাজার ৭২৭ ডলার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বায়নের এই কালে বাণিজ্য আটকে রাখা সম্ভব নয়, বড়জোর সীমিত করে রাখা সম্ভব। আর যদি চাহিদা থাকে, তাহলে সোজা পথে না পারলে ঘুরপথে পণ্যের আসা-যাওয়া চলবে। ইসরায়েলি তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির একাধিক যন্ত্রপাতিও এভাবে বাংলাদেশে আসাটা অস্বাভাবিক নয়। ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎস কিছুদিন আগে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এ অবস্থায় ইসরায়েলের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্যের বিষয়ে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া জরুরি। সরকারি পরিসংখ্যানেও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন বিভ্রান্তি দূর করার জন্য।
তা ছাড়া তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পণ্য আমদানি-রপ্তানিও বিশ্ববাণিজ্যে একটি স্বীকৃত বিষয়। বিশেষ করে গ্লোবাল ভ্যালু চেইন (জিভিসি) বা বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলের বিস্তার ঘটায় অনেক ক্ষেত্রেই একটি পণ্য আসলে যে দেশে উৎপাদিত পণ্য হিসেবে পরিচিত পায়, বাস্তবে বিষয়টি সে রকম নয়। পণ্যের একাধিক কাঁচামাল আসছে চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পণ্যের নকশা তৈরি হচ্ছে মালয়েশিয়ায়, প্রযুক্তি জাপানের, একাংশ সংযোজিত হচ্ছে থাইল্যান্ডে, আরেকাংশ সংযোজিত হচ্ছে ভারতে আর সংযোজিত দুই অংশ পূর্ণাঙ্গ অবয়ব নিচ্ছে বাংলাদেশে। তারপর তা বাংলাদেশে তৈরি পণ্য হিসেবে যাচ্ছে জার্মানিতে। জিভিসির এই বিস্তার হয়তো বাংলাদেশ-ইসরায়েল বাণিজ্যকেও এগিয়ে নিচ্ছে, আমরা তা পছন্দ করি বা না করি।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ