এত সময় ও চেষ্টার পর যে যুদ্ধবিরতি তার প্রভাব কতখানি? আমেরিকা তিন দশক ধরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন পরিস্থিতি খুব কাছ থেকে দেখছে। তবু পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন দীর্ঘদিন বিবাদের বিষয় হয়েই আছে। সম্প্রতি মে মাসে হওয়া যুদ্ধে ২৪২ জন ফিলিস্তিন এবং ১০ জন ইসরায়েলি মারা যান, যা কিনা পরিস্থিতিকে আরও বিপথে নিয়ে গেছে। পরবর্তী হামলা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।
শান্তির লক্ষ্যে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে ১৯৯৩ সালে অত্যন্ত গোপনে এক আপোষ মীমাংসার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি সই হয়েছিল, যা অসলো চুক্তি নামে পরিচিতি পায়। এই চুক্তির মধ্যে ছিল, ভূমি ব্যবহারের অধিকার, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, জেরুজালেম ভাগ করে নেয়া, ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘রাইট অব রিটার্ন’। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলকে স্বীকার করে নেয়, বদলে তারা পায় স্বশাসনের সুযোগ। এই চুক্তি শান্তির খুব কাছাকাছি গেলেও আদোতে তা সম্ভব হয়নি।
এই সময়ে এসে সবাই এমনটা দেখাচ্ছে, এখনও তাদের উদ্দেশ্য শান্তি। কিন্তু বাস্তবে তা না। এটা যুদ্ধের কৌশল। একদিন ফিলিস্তিনে শান্তি কায়েম হবে, এই আশ্বাসের সুযোগে আরও বেশি শোসনের শিকার হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। এটা মূলত এক রাষ্ট্রের দিকেই এগিয়ে যাওয়া। যেখানে ফিলিস্তিনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আবার দুই রাষ্ট্রের পরিকাঠামো যে ক্ষতিকর তা ফিলিস্তিনিদের কতটা অজানা! এর আওতায় টেকসই, সার্বভৌম ফিলিস্তিনের সম্ভাবনা কতটা থাকবে! পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বের সমুদ্রে একটা দ্বীপের মতো। গাজা এক নির্জন দ্বীপ। যাকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করছে ইসরায়েল ও মিশর। ফিলিস্তিন সরকার গঠনের প্রতিক্ষায়। যদিও ইয়াং ফিলিস্তিন তাকে ইসরায়েল শাসনের এজেন্ট হিসেবেই দেখছে। যদিওবা তারা হামাসের পক্ষেই থাকছে।
তবে দুই রাষ্ট্রের থেকে এখন নতুন ফিলিস্তিন এক রাষ্ট্রে প্রতিটা মানুষের অধিকার নিয়ে বেশি সচেতন। গাজা এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলের অনুমতি লাগছে নিজের পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য। সম্প্রতি যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেমের ভূসম্পত্তি নিয়ে কলহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনিরা নিছক বাসিন্দা। এমনকি ইসরায়েলি আরবেরাও এই অসমতা নিয়ে গাজায় চলা যুদ্ধের সময় অভিযোগ জানিয়েছে।
যা কিনা সঙ্কটে ফেলেছে ইসরায়েলকে। এটা অসলোর নিচে চাপা পড়ে ছিল। গত ৩০ বছরে জিডিপি পার হেড প্রায় অর্ধেক বেড়েছে। ইসরায়েলের আইরোন ডোম মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম একে হামাসের অধিকাংশ হামলা থেকে রক্ষা করেছে। ফিলিস্তিনের দুর্বল নেতৃত্ব নেতানিয়াহুকে সুযোগ দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে না ভাবতে বা সামান্য ভাবতে, যা কিনা না ভাবার মতোই।
কিন্তু এটা চলতে পারে না। অসলোকে ঢাল বানিয়ে ইসরায়েল দাবি করছে ফাইনাল ডিলে দখলদারিত্ব পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে। তাদের মূলত পশ্চিম তীরে পূর্ণ অধিকার কায়েম করার কোনও দায়িত্ব নেই। তবে ৬ দিনের যুদ্ধের পর ৫৪ বছর পার হয়ে গেলে ‘সাময়িক দখলদারিত্ব’ তাকে আর বলা যায় না।
এদিকে, কোনও চুক্তির আশা ছাড়াই, ইসরায়েলি ক্রিটিকেরা ‘ওয়ান স্টেট রিয়েলিটি’ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। এটা ইসরায়েলের জন্য চ্যালেঞ্জের। কারণ এই পবিত্র ভূমিতে ইহুদি আর ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা সমান। তাই এটা একই সাথে ইহুদি জাতীয় এবং গণতান্ত্রিক হতে পারে না যখন তারা চিরতরে এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করবে। অনেক ইসরায়েলি ক্রিটিক বর্তমান পরিস্থিতিকে জাতিবিদ্বেষ হিসেবে দেখছে।
ফিলিস্তিনিদের দাবি এখন সারাবিশ্বের আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি আমেরিকার কংগ্রেসও মুখ খুলতে শুরু করেছে। আমেরিকার উদারতান্ত্রিকদলগুলো বলতে শুরু করেছে, ফিলিস্তিনিদের জীবনের মূল্য আছে। আমেরিকা ইসরায়েলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। এটা সত্য যে আমেরিকার সাহায্য আগের মতো গুরুত্ব রাখে না এখন। ইসরায়েল এখন নিজেই তাদের প্রয়োজনীয় আধুনিক অস্ত্র তৈরি করে। অনেক দেশের সাথেই ইসরায়েল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে, এমনকি প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সাথেও। যদিও এটি ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো থেকে কিছুটা সরে যাচ্ছে। এটা ইসরায়েলের পশ্চিমা, উদার ও গণতান্ত্রিক তকমার জন্য ক্ষতিকর।
এছাড়া নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিন নিয়ে সমাধানের বিপরীতে হাঁটার আগ্রহ সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ইসরায়েলের মধ্যেই তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত হচ্ছে ইহুদিরা। নেতানিয়াহুর নীতির কারণে আয়ারল্যান্ড ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ইসরায়েলের বিরোধীতা করছে। এবারের হামলায় বেশ ক্ষতির মুখেও পড়তে হয়েছে ইসরায়েলকে। যে দেওয়াল ইসরায়েল ও পশ্চিম তীরের মধ্যে প্রাচীর হয়ে আছে, তা আরও গভীর অবিশ্বাসের দিকে নিচ্ছে আরব ও ইহুদিদের সম্পর্ককে। যে সেটেলমেন্ট এক সময় মনে হয়েছিল আলোচনার যোগ্য, তা এক চিরস্থায়ী সমস্যায় মোড় নিয়েছে।
তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে এক রাষ্ট্র ব্যবস্থাই বেশি কার্যকর মনে হচ্ছে। কারণ দুই রাষ্ট্র বেশি কঠিন ও দ্বান্দ্বিক। এদিকে, যেকোনও নীতির একটি অংশ হওয়া উচিত ফিলিস্তিনিদের অধিকার সুনিশ্চিত করা। ইসরায়েল রাতারাতি ফিলিস্তিনিদের দাবি দাওয়া মেনে নেবে না। কিন্তু তারা আরব ও ইহুদিদের মধ্যকার বিভেদ কমিয়ে আনতে পারে। জেরুজালেমের প্রশাসনকে আরও সুসংহত করতে পারে। ইসরায়েলের আরও বেশি দায়িত্ব নেয়া উচিত পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে, যা পরিস্থিতিকে প্রশমিত করবে।
এছাড়া অধিকারের উপর নজর দিলে ফিলিস্তিনি নেতাদের আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। তারা খুব সহজে ইসরায়েলের কাছে অধিকার দাবি করতে পারে না। মাহমুদ আব্বাস ১৭ বছর ধরে প্রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনের। তবে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেই। এদিকে হামাস নিজের মানুষদের অধিকার পদদলিত করছে, যার মধ্যে আছে মহিলা এবং সংখ্যালঘু। ভালো ফিলিস্তিনি নেতা মূলত তাদের শান্তির পূর্বশর্ত।
অসলো চুক্তি থেকে সরে আসা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ইসরায়েল তাদের দখলদারিত্ব বাড়িয়েই চলেছে। হামাস নিজেদের সংঘবদ্ধ করেছে। তাদের এক রাষ্ট্রের চিন্তায় আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। তবে বর্তমানের পরিস্থিতি আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
শান্তি সবসময় বাস্তবতারে স্বীকার করেই শুরু হয়। এটি মানুষের জীবনযাত্রাকে উন্নত করে, রাজনীতির পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে নিজের শেকড় গেঁথে দেয়। এরপরই দুই পক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, দুই রাষ্ট্র নাকি এক।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫১১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ