দেশে ইসলামি দলগুলোর বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকারের ভূমিকা নিয়ে ধর্মীয় সমাজে এক নেতিবাচক সমালোচনা রয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশের ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে খড়গ হস্ত বলেও অভিযোগ রটে আছে। তার চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছায় জামাতে ইসলাম দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জামাতে ইসলাম দলকে বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়ে। এরপরেই সরকার তাদের বিরুদ্ধে রটে যাওয়া বদনাম ঘুচাতে ইসলামি দলগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার নীতি মেনে চলে। তবে তাতেও সুবিধা করতে পারেনি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে বিরোধীতা করে হেফাজতে ইসলাম যে তাণ্ডব চালায় তাতে বেকায়দায় পড়ে যায় সরকার। এরপরেই আগের রুপে ফিরে আসে। হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে নামে সরকার। তবে হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের উদ্দেশ্য হেফাজতকে বিলুপ্ত করা নয়, বশে আনা। এমনি জানিয়েছে ইকোনোমিস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে।
ইকোনোমিস্ট লিখেছে, মার্চের শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের পঞ্চাশতম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে তার ঢাকা সফরে খুশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিজ দেশে মুসলিম নিপীড়নের অভিযোগে মোদীকে নিন্দা করার জন্য হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার কর্মী রাস্তায় নেমে আসে, পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ১৩ জন মারা গিয়েছিলেন। সরকার বিক্ষোভের পিছনে ইসলামী আন্দোলন হেফাজতে ইসলামের কয়েকশ সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে। এই কঠোর অবস্থান বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের কৌশল পরিবর্তনের চিহ্ন হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এটি গত দশকটির বেশিরভাগ সময় এই মৌলবাদী গোষ্ঠী কাটিয়েছে।
ইকোনোমিস্ট লিখেছে, হেফাজতে ইসলাম, যার অর্থ “ইসলামের রক্ষাকারী”, ২০১০ সালে চট্টগ্রাম শহরের ইসলামী শিক্ষকরা নারীদের উত্তরাধিকার আইনকে আরও অনুকূল করার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর গঠিত হয়েছিল।
এর আগে রাজনীতিতে ইসলাম প্রচারের কাজটি মূলত জামায়াতে ইসলামী এবং মূলধারার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের( বিএনপি) মতো ধর্মীয় দলগুলিতে পড়েছিল।২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পরে এটি পরিবর্তিত হয়েছিল। তার সরকার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করা জামায়াতের সিনিয়র সদস্যদের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের আওতায় এনেছিল।
২০১৩ সালে হেফাজতের প্রভাব প্রবলভাবে বেড়ে যায়, যখন এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা জামায়াতের উচ্চ পদস্থ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে অস্বীকার করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগে তখন হাজার হাজার লোক আন্দোলন করেন। হেফাজতে ইসলাম দেখলো যে, এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা ইসলামের অবমাননা করছে। এরপরেই ব্ল্যাস্ফেমি আইনের মাধ্যমে অনলাইন ব্লগার নাস্তিকদের শাস্তির দাবি নিয়ে তারা ওই বছরের মে মাসে রাজধানীরর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে একত্রিত হয়। সরকার তখন তাদের বিচ্ছিন্ন করার পরিবর্তে শান্ত করতে চায়। তারা অনেক লেখকের বিরুদ্ধেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ আনে এবং ইসলাম সম্পর্কে পুলিশি ভাষ্যগুলির একটি প্যানেলও স্থাপন করেছিল।
এতে শেখ হাসিনার সরকার এবং হেফাজতের মধ্যে একটি বেসরকারী জোট গঠনে সহায়তা করেছিল। দলটির সাথে আলোচনার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে ধার্মিকদের মধ্যে কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছে (তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন)।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির আলী রিয়াজ ইকোনোমিস্টকে বলেছেন যে, হেফাজতকে প্রশ্রয় দিয়ে আওয়ামী লীগ এটাই জানাতে চেয়েছে যে “আমরা জামায়াতের বিপক্ষে, তবে ইসলামের বিপক্ষে না”।
এরপরেই সরকার হেফাজতের অনেক দাবি মঞ্জুর করেছে। ২০১৫ সালে, যখন রাস্তায় নাস্তিক লেখকদের একটি স্ট্রিং খুন করা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদরা ইঙ্গিত দিয়েছিল যে তারা এর প্রাপ্য ছিল। দু’বছর পরে সরকার হেফাজতকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারের অভিযোগে অভিযুক্ত লোকদের লেখা কবিতা ও গল্পগুলি সরিয়ে দেওয়ার জন্য স্কুলের পাঠ্যপুস্তকগুলি সংশোধন করে। সরকার আরও ঘোষণা করে যে মাদ্রাসা থেকে প্রাপ্ত ডিগ্রিগুলি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্নাতকোত্তর যোগ্যতার সমতুল্য বিবেচিত হবে, যাতে তারা ভাল সরকারী চাকরীর জন্য যোগ্য হয়ে ওঠে।
মিঃ রিয়াজ ইকোনমিস্টকে বলেন, হেফাজতের সাথে সরকারের সম্পর্কের ফলে বাংলাদেশি সমাজে দ্রুত ইসলামিকরণ ঘটেছিল। শিশুদের স্কুলে পাঠানোর চেয়ে মাদ্রাসায় পাঠানোর হার বেড়ে গেল। একইসাথে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণও বেড়ে গেল।
পরে হেফাজতের নেতারা অপরিহার্য হলেও নরেন্দ্র মোদীর সফরকে বিরোধীতা করা যে হিসাবের ভুল ছিল তা বুঝতে পেরেছেন। একইসাথে বুঝতে পারেন যে শেখ হাসিনা সরকার ক্রমশ স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছে। কর্মীদের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত করার পরিবর্তে হেফাজতের প্রধান জুনায়েদ বাবুনগরী সরকারকে কেবল কারাগারে থাকা সকলকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইকোনোমিস্ট বলছে, শেখ হাসিনা অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা শুরু করেছিলেন তার বিপরীতে হেফাজতের বিরুদ্ধে এই কঠোরতার উদ্দেশ্য হেফাজতকে বিলুপ্ত করা নয়, বশে আনা। সরকারের সাথে সম্পর্ক মেরামত করতে আগ্রহী দলগুলির মধ্যে এরই মধ্যে সুনাম অর্জন করেছে সরকার।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ওপর সরকারের সেভাবে নিয়ন্ত্রণও ছিল না। তারপরও সরকার হেফাজতকে পুরোপুরি বৈরী অবস্থানে ঠেলে দিতে চায়নি। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর সংগঠনটির ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চাপে ফেলে সংগঠনটির নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও লক্ষ্য রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র থেকে জানা গেছে, হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রায় সবার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে থাকা পুরোনো মামলাগুলো সচল করা হচ্ছে। সব দিক থেকে চাপে ফেলে সংগঠনটির নেতৃত্বে আগের মতো একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েও এগোচ্ছে সরকার। এ জন্য রমজান মাস ও করোনার কারণে চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে কাজে লাগিয়েছে। হেফাজত যেকোনো পরিস্থিতিতে মূলত মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহার করে থাকে। কওমি মাদ্রাসাগুলো রমজানের ছুটিতে বন্ধ থাকায় সময়টাকে হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। এ ছাড়া হেফাজতের নেতৃত্বের আইনি ব্যবস্থা জোরদার করার ক্ষেত্রে সংগঠনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বিতর্ক সরকারের জন্য সহায়ক হয়েছে। বিষয়টি সাধারণ মানুষের মধ্যে মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যা হেফাজত নেতাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় অন্য নেতাদেরও ‘দুর্বল’ দিক খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি আর্থিক কেলেঙ্কারি, মাদ্রাসা পরিচালনায় অনিয়ম, মাদ্রাসার তহবিল ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম থাকলে সে বিষয়গুলোও সামনে আনা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একটা অংশ মনে করেন হেফাজতকে চাপে রাখার বিকল্প নেই। কারণ, ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরের অবস্থান ও ব্যাপক সহিংসতার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে হেফাজতে ইসলাম কিছুটা পিছু হটেছিল। এরপর সরকার হেফাজতের নেতৃত্বের একটা অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। এরপর হেফাজতের অনেক দাবি সরকার মেনেও নিয়েছিল। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে আইন পাস করে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমান করা হয়। যার ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ ‘শোকরানা মাহফিলের’ আয়োজন করে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেওয়া হয়।
তবে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনের নতুন কমিটিতে সরকারঘনিষ্ঠ নেতারা স্থান পাননি। এরপর সরকারের সঙ্গে হেফাজতের পর্দার অন্তরালের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থান নিয়ে হেফাজত একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও দ্রুত সে অবস্থান থেকে সরেও আসে। সরকারের দিক থেকেও তখন কঠোর না হয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে নরেন্দ্র মোদীর সফর ঘিরে হেফাজতের অবস্থান এবং পরে সহিংসতার ঘটনায় সংগঠনটির ব্যাপারে সরকার শক্ত অবস্থান নিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ