করোনা মহামারির মধ্যেই আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানির দাম ৫ শতাংশ হারে বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। সোমবার ওয়াসার বোর্ড সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এটা আগামী জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
জানা যায়, নতুন দর অনুযায়ী আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম দাঁড়াবে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। বর্তমানে এক হাজার লিটার পানির দাম ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা। নতুন দাম কার্যকর হলে বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম দিতে হবে ৪২ টাকা, যা আগে ছিল ৪০ টাকা।
পানির দাম বাড়ানোর এ প্রস্তাব গত মার্চেই দিয়েছিলেন ওয়াসার এমডি। তার প্রস্তাব সিদ্ধান্ত আকারে কার্যকর করার জন্য ওয়াসার বোর্ড সভায় অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। ঐ মাসে অনুষ্ঠিত ওয়াসার ২৭৮তম বোর্ড সভায় পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল ওয়াসার। কিন্তু ঐ বোর্ড সভায় করোনাকালীন পানির দাম বাড়ানো নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়লে সে সময় এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ঢাকা ওয়াসা।
ওয়াসার বোর্ড সূত্র বলছে, পানির দাম বাড়াতে শুরু থেকেই তাকসিম সবচেয়ে তৎপর ছিলেন। ওয়াসায় যেকোনো সিদ্ধান্তে তার অবস্থানই প্রাধান্য পায়। তাকসিম এ খান গত মাস এপ্রিলে তিন মাসের ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে থেকে তিনি ওয়াসার নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন বিষয়ে ফোন ও অনলাইনে তদারকি করছেন।
২০০৯ সালে প্রথম দফায় নিয়োগ পাওয়ার পর আর পদ ছাড়তে হয়নি তাকসিম এ খানকে। নাগরিক সেবার মান নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও নানা বিতর্কের মুখে পড়লেও ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে বারবার পুনর্নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। ষষ্ঠবারের মতো তাকসিম এ খানকে ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয় গত ১ অক্টোবর। প্রতিবারই তার নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
ওয়াসা জানায়, পানির উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে অনেক ব্যবধান। বর্তমানে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির উৎপাদনে প্রায় ২৫ টাকা ব্যয় হচ্ছে। আর তা বিক্রি করতে হচ্ছে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সায়। ওয়াসার আইন ১৯৯৬ এর ২২ (২) ধারা অনুযায়ী সংস্থাটির বোর্ড ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, ঢাকা ওয়াসা আইন অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতির সমন্বয় করতে ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়ানোর ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। সে ক্ষমতাবলে এ দাম বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, “প্রতি স্তরে ৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির জন্য মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আয়-ব্যয়ের সমন্বয়টা খুব জরুরি। গত এক বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। সেজন্যই দামটা সমন্বয় করা হয়েছে। প্রতি বছরই এমনটা করা হয়।”
গোলাম মোস্তফা জানান, ‘দাম বাড়ানো নয়, আমরা একে দাম সমন্বয় বলি। প্রতি বছর পানি উৎপাদন করতে গিয়ে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। আইন অনুযায়ী সেই খরচ সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে।’
২০২০ সালের এপ্রিলেও পানির দাম বাড়িয়ে ছিল ঢাকা ওয়াসা। তখন আবাসিকে প্রতি ইউনিটের দাম বেড়েছিল ২ টাকা ৯০ পয়সা।
এর আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, ২০১৮ সালের জুলাইতে, ২০১৭ সালের অগাস্টে পানির দাম বাড়িয়ে ছিল ঢাকা ওয়াসা।
আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর থেকে গত প্রায় ১৩ বছরে মোট ১৪ বার পানির দাম বেড়েছে। একই সময়ে পানির দাম প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালে ঢাকায় আবাসিক গ্রাহকদের জন্য পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। দাম বাড়ানোর কারণে আগামী জুলাই থেকে তা হচ্ছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা।
টিআইবি গবেষণায় উল্লেখ করেছিল, ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করে।
অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকেরা বিভিন্ন সময়ে ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ, ময়লা থাকার অভিযোগ করে আসছে। ওয়াসার পানির মান কেমন এবং তা পানের উপযোগী কি না, তা দেখাতে ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিলে কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের সামনে পরিবার নিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান। তার ইচ্ছা ছিল ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানকে ওয়াসার পানি দিয়ে বানানো এক গ্লাস শরবত খাওয়ানোর। সেদিন তার আহ্বানে সাড়া দেননি এমডি।
করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছেন। অনেকে চাকরিহারা হয়েছেন। নগরে দারিদ্র্য বেড়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এখনই দাম বাড়ানো ঠিক হবে না বলে তিন থেকে চারজন সদস্য সভায় মত দিয়েছিলেন। কিন্তু আইন অনুযায়ী প্রতিবছর পানির দাম বাড়ানো যায় এবং দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাড়াতে হবে— এসব যুক্তিতে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। উল্লেখ্য, ওয়াসার বোর্ড সভার সদস্য ১৩ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময়ে ঢাকা শহরের একটি বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী আর্থিকভাবে ভীষণ রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, আয়ের ক্ষেত্রে এই শহরের একটি বৃহৎসংখ্যক মানুষের ওপর বড় ধরনের আঘাত এসেছে। সানেমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপেও এটা উঠে এসেছে যে মহামারির এই সময়ে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার, এমনকি সাধারণ পরিবারের আয়ও বেশ বড় পরিমাণে কমে গেছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে আবাসিক ও বাণিজ্যিক— দুই জায়গাতেই পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত একেবারেই যৌক্তিক নয়।
তারা বলেন, সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের বাইরে বসে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সিদ্ধান্ত দেবেন, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি এমডির পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্বশীল আচরণেরও প্রকাশ নয়।
তারা বলেন, করোনা মহামারির এই সময়ে একদিকে যেমন বিভিন্ন আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন শিল্পকারখানা এবং সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান, যারা নিয়মিত পানি ব্যবহার করে, তাদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন এই পরিস্থিতিতে পানির দাম বাড়ানোর ফলে যেসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় আছে এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তাদের কাছে বিষয়টি বাড়তি বোঝা হিসেবে আসবে।
বলেন, আমরা পানির উৎপাদন খরচ এবং দামের মধ্যে যে পার্থক্য দেখি, উৎপাদন পর্যায়ে নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা তার একটা বড় কারণ। নানা ধরনের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা উৎপাদন খরচকে বাড়িয়ে দেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ