এমন এক সরকারি কর্মচারীর দুর্নীতির তথ্য এসেছে, যিনি ঘড়ির কাঁটা মেপে অফিস করলেও সম্পদ অর্জনে ভেঙেছেন সব মাপজোখ। তিনি ঢাকা ওয়াসার পাম্প অপারেটর মো. বদিউল আলম। তবে তিনি নিজেকে পরিচয় দেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।
ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে ২ হাজার ২০০ টাকা মূল বেতনে শিক্ষানবিশ পাম্প অপারেটর হিসেবে ঢাকা ওয়াসায় যোগ দেন বদিউল আলম। তাঁর বর্তমান কর্মস্থল ওয়াসার জোন ৯-এ। অবৈধ সংযোগ দিতে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে গত দুই দশকে গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে বদিউলের বিরুদ্ধে।
বদিউল আলমের অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেসব নথি এসেছে, এগুলোর বেশির ভাগের সত্যতা পেয়েছে আজকের পত্রিকা। নিজের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকার কথা স্বীকারও করেছেন বদিউল। এগুলোর মধ্যে ব্যবসায়িক অংশীদারত্বে মাতৃভূমি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি, মাল্টিপ্ল্যান হোল্ডিংস লিমিটেড, স্ত্রীর নামে ফার্মেসি, ফ্যাব্রিকস ও ঠিকাদারি ব্যবসার কথা জানিয়েছেন তিনি। তবে এসব সম্পদ বৈধভাবেই অর্জন করেছেন বলে দাবি বদিউলের।
সম্প্রতি সরেজমিনে রাজধানীর মেরুল বাড্ডার আনন্দনগর এলাকায় পাঁচ কাঠার একটি প্লটে বদিউলের মালিকানাধীন তিন ইউনিটের ১০ তলার একটি ভবন দেখা গেছে। আফতাবনগরে ১৭ কাঠার একটি প্লটে ১০ তলার আরও একটি ভবন নির্মাণকাজ শুরু করেছেন তিনি। অন্যদিকে বদিউল নিজ ও তাঁর স্ত্রীর নামে বনশ্রীর ‘এ’ এবং ‘সি’ ব্লকে দুটি ফ্ল্যাট, বনশ্রীর মেরাদিয়া এলাকায় তিনটি দলিলে বদিউলের নামে আরও একটি প্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
আনন্দনগরে বদিউলের ভবনে কাজ করেন এমন একজন শ্রমিক বলেন, ‘এটা বদিউলেরই বাড়ি।’ ঢাকা ওয়াসার বদিউল কি না নিশ্চিত হতে চাইলে ওই শ্রমিক বলেন, ‘হ, এইডা ওয়াসার বদিউল স্যারের বিল্ডিং, সামনের জায়গাডাও হের। এইখানে পাইলিং করতাছি। ১০ তলা আরেকটা বিল্ডিং হবে।’
ফ্ল্যাট কেনার ছুতোয় ভবনটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি বদিউল আলমের একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে দেন। তারপর বলেন, ‘ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে স্যারের কাছে ফোন করে জানতে পারবেন, আমরা কিছু জানি না।’ ওই নিরাপত্তাকর্মীর কাছে তাঁর নাম জানতে চাইলেও বলেননি। ওই ব্যক্তির দেওয়া ভিজিটিং কার্ডে উল্লেখ রয়েছে, মাল্টিপ্ল্যান হোল্ডিংস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদিউল।
ঢাকা ওয়াসার একটি সূত্র জানায়, ২০০১ সালে অস্থায়ী ভিত্তিতে পাম্প অপারেটর হিসেবে যোগ দেন বদিউল আলম। ২২ বছর ধরে শিক্ষানবিশ পাম্প অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। আর এই সময়ে গড়ে তুলেছেন বিপুল বিত্তবৈভব।
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে বদিউল আলমকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নাই। আমি ৩ লাখ টাকা দিয়ে ২০ বছর আগে একটি পাঁচ কাঠার জায়গা কিনেছিলাম। সেটাই ডেভেলপ করে ১০ তলা করেছি। ১৭ কাঠার আরেকটা প্লটে ১০ তলার প্ল্যান পাস করিয়েছি, সেটার কাজ চলছে।’ ঢাকা ওয়াসা থেকে তিনি মাসিক কত টাকা বেতন পান জানতে চাইলে নিজের বেতনের কথা ‘মনে নেই’ বলে জানান ওয়াসার এই কর্মচারী।
পাম্প অপারেটর পদে চাকরি করেই এসব সম্পদ করেছেন কি না জানতে চাইলে বদিউল বলেন, ‘আমি একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।’ কোথা থেকে পাস করেছেন, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে পাস করেছি।’ তবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ‘পাম্প অপারেটর’ পদে কেন কাজ করছেন, এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
ওয়াসা থেকে পাওয়া তথ্যে উল্লেখ রয়েছে, বদিউল ওয়াসা থেকে সাকল্যে মাসিক ২১ হাজার ৫১৩ টাকা বেতন পান। যোগদানের দিন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সব মিলিয়ে তাঁর বৈধ উপার্জন প্রায় ৩২ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯০ টাকা।
ওয়াসার সূত্রটি জানায়, বদিউল নিজে যেসব ব্যবসার কথা স্বীকার করেছেন, ব্যবসা পরিচালনা করছেন, সেগুলোর কোনোটির ঘোষণা বা অনুমতি ঢাকা ওয়াসা থেকে নেওয়া হয়নি।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ১৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন না। অন্য কোনো চাকরি বা কাজ গ্রহণ করতে পারবেন না। পরিবারের সদস্য অর্থাৎ স্ত্রী-সন্তানও ব্যবসা করতে পারবেন না।’সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির বিষয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, ‘দুর্নীতি বিষয়ে দুদক আপসহীন, আমরা সে কাজটাই করছি। তবে বিভিন্ন দপ্তরে কর্মকর্তা কর্মচারীদের দুর্নীতির বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা বা শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক হলে দুর্নীতি অনেকখানি কমে যেত।’
আপনার মতামত জানানঃ