মমতার মন্ত্রী সভার দুজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়সহ তৃণমূল বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র, তৃণমূল ত্যাগী বিজেপির নেতা ও প্রাক্তন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে আজ সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সকালে সিবিআই তাদের বাসভবন থেকে তুলে কলকাতার নিজাম প্যালেসে সিবিআই কার্যালয়ে নেয়। আজই সিবিআই তাদের আদালতে তুলছে।
সিবিআই সূত্রের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ নিজাম প্যালেসে অ্যারেস্ট মেমোয় সই করানো হয় এই চারজনকে। সোমবার সকালে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র, তৃণমূলের বিধায়ক এবং মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের চেতলার বাড়ি ঘিরে ফেলে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সকাল ৯টার দিকে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় সিবিআই।
ফিরহাদকে বাড়ির বাইরে আনা হতেই তার সমর্থকরা স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বচসাও হয়। তাদের শান্ত করেন ফিরহাদই।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ফিরহাদ বলেন, নারদ মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। বিনা নোটিসে আমাকে গ্রেপ্তার করা হল। স্পিকারের অনুমতি ছাড়াই আমায় গ্রেপ্তার করা হল। আদালতে দেখে নেব।
এদিকে সোমবার সকালেই মদন মিত্র এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নিজাম প্যালেসে নিয়ে যাওয়া হয়। নিজাম প্যালেসে আনা হয় রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কেও। সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বলে সিবিআই সূত্রের খবর।
যদিও সিবিআই সূত্রে প্রথমে দাবি করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয়নি ফিরহাদকে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের চারজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে বেলা গড়াতে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানা যায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে।
সূত্রের খবর, সোমবারই নারদকাণ্ডে এই চার জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে জমা দেবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। চার্জশিটের বয়ান ঠিক করে নয়াদিল্লিতে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন আসার পরই তড়িঘড়ি এই ৪জনকে তুলে আনা হয় বলে সিবিআই সূত্রে খবর।
কিছুদিন আগেই নারদ মামলায় চার্জশিট গঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। সেই মামলার সূত্রেই সিবিআই আধিকারিকদের হানা বলে অনুমান। যদিও সিবিআই-এর তরফে এ বিষয়ে এখনও কিছু জানানো হয়নি।
জিনিউজের খবরে বলা হয়, নারদা মামলায় ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্রকে নিজাম প্যালেসে সিবিআই দফতরে তুলে নিয়ে যায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তার পর সেখানেই পৌঁছে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অন্যদিকে, এই গ্রেপ্তারি আইন অনুমোদন করে না। আইন না মেনেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে ফিরহাদ হাকিমকে। বিধায়কদের গ্রেপ্তারের পরেই মন্তব্য করেছেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। নিয়ম অনুযায়ী, কোনও বিধায়ককে গ্রেপ্তার বা তার বিরুদ্ধে তদন্ত চালাতে স্পিকারের অনুমতি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে সাংবাদিক ম্যাথু স্যামুয়েল জানিয়েছেন, তিনি সকালেই শুনেছেন, তৃণমূলের সিনিয়র মন্ত্রী ববি হাকিম এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে সিবিআই গ্রেপ্তার করেছে। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে বিচার পাওয়া গেল বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। যে কাজ তিনি করেছিলেন, তা জনগণের সামনে আসে ২০১৬-তে।
২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে কলকাতায় আসেন সাংবাদিক ম্যাথু স্যামুয়েল। পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক বলে জানিয়ে তৃণমূলের প্রভাবশালী কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় নির্বাচনের আগে তাদের হাতে টাকা তুলে দেন এবং সেই লেনদেনের ছবি লুকিয়ে তুলে নেন মোবাইলের ক্যামেরায়।
পরে ২০১৬ সালে নারদা ডট কম নামের একটি নিউজ পোর্টাল তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা, মন্ত্রী এবং কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করে। এই ঘটনায় সে সময় ভারতজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এরপর তৃণমূলের বহু নেতা, সাংসদ এবং মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন করে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।
২০১৬ সালের মার্চে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের ঘুষ নেওয়ার এক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। তা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১৭ সালে মার্চে এই নারদা কেলেঙ্কারি মামলার তদন্তের ভার দেওয়া হয় ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআইকে। যদিও ২০১৬ সালে এই নারদা স্টিং অপারেশনের তথ্য ফাঁস হওয়ার পর প্রথম এই মামলার তদন্ত ভার গ্রহণ করে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট—ইডি।
সেই মামলায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন চার মন্ত্রীসহ অন্য তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের আসামি করা হয়। কিন্তু মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে গেলে রাজ্যপালের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সেই লক্ষ্যে সিবিআই রাজ্যপালের কাছে অনুমতি চাইলে দীর্ঘদিন পর রাজ্যপাল এই চার নেতার বিরুদ্ধে মামলা চালানোর অনুমতি দেন সংবিধানের ১৬৩ ও ১৬৪ ধারামতে।
সিবিআই অফিসে মমতা হাজির
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পরিবহন মন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিমসহ তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তারের পর সিবিআই দফতরে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সোমবার সকালে ফিরহাদ ও তৃণমূল কংগ্রেসের তিন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর নিজাম প্যালেসের সিবিআই দফতরে যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে বলা হয়, সোমবার সকালে নবান্নে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন মমতা। তবে বাড়ি থেকে সোজা চলে আসেন নিজাম প্যালেসে। সকাল ১০টা ৪৭ মিনিটে নিজাম প্যালেসে এসেই সোজা দুর্নীতিদমন শাখার ১৫ তলার অফিসে চলে যান তিনি।
তৃণমূল নেতা আইনজীবী অনিন্দ্য রাউত জানান, ‘বেআইনিভাবে’ গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে তাকেও গ্রেপ্তার করতে হবে বলে দাবি তুলেছেন মমতা। নাহলে তিনি সিবিআই দফতর থেকে বেরোবেন না।
তিনি বলেন, ‘মমতা জানিয়েছেন, বেআইনিভাবে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আমায় গ্রেপ্তার করতে হবে না হলে আমি সিবিআই দফতর থেকে বেরোবো না।’
অন্যদিকে, নিজাম প্যালেসে বাড়ানো হল নিরাপত্তা। গোটা নিজাম প্যালেস ঘিরে ফেলা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে। দফতরের গেট আটকে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, তৃণমূলের তিন বিধায়ক গ্রেপ্তারের পরেই বিভিন্ন জায়গা থেকে অশান্তির খবর সামনে আসছে। অনুগামীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গাতে চলছে অবরোধ। অন্যদিকে নিজাম প্যালেসের বাইরেও ভিড় বাড়ছে অনুগামীদের। চলছে দফায় দফায় বিক্ষোভ। এরপরে বেড়েছে নিরাপত্তা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ