দেশে করোনা টিকার চাহিদা মেটাতে সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে স্পুটনিক-ভি টিকা কিনতে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হলেও এখনো দুদেশের মধ্যে কোনো চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। তবে একটি প্রস্তাবিত চুক্তিপত্র পাঠিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার কাছ থেকে ‘স্পুটনিক-ভি’ টিকা আনার জন্য সে দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আরডিআইএফ যে সরবরাহ চুক্তি তৈরি করেছে, তার বেশ কিছু শর্ত বা ধারা নিয়ে আপত্তি রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।
এ প্রস্তাবে প্রায় ৩০টি বিষয়ে সংশোধন আনতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। সেখানে ১০নং সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রতি ডোজ টিকার দাম ৯ দশমিক ৯৫ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অত্যধিক বলে প্রতীয়মান হয়। তাই টিকার দামের জন্য দরকষাকষি করা আবশ্যক।’
মন্ত্রণালয় বলছে, আরডিআইএফ যে সরবরাহ চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে, তা মেনে নিলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ১৮ পাতার এই চুক্তিপত্র আইন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে।
সরকারের এ সংশোধনী প্রস্তাবের সঙ্গে একমত দেশের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, টিকার মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি কূটনৈতিক তৎপরতা ও রাশিয়ায় পর্যাপ্ত উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে।
তবে এ তৎপরতার পাশাপাশি টিকা উৎপাদনকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোও জরুরি। কারণ একবার টিকা দিয়েই করোনা নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জাতীয় এক দৈনিককে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সরবরাহ চুক্তিপত্রের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে আটটি ধারা ও উপধারা নিয়ে তারা আপত্তি করেছেন। এ ছাড়া টিকার দামও অনেক বেশি, যা নিয়ে দর-কষাকষি করা উচিত বলে মনে করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রতি ডোজ ৯ দশমিক ৯৫ ডলার রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের এ প্রস্তাবের বিপরীতে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু সংশোধনী পাঠানো হয়েছে। যেখানে দাম কমানোর জন্য দরকষাকষি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত দুই ডোজের দাম মডার্না বা ফাইজারের এক ডোজের চেয়ে কম।
তিনি আরও বলেন, চায়নার যে টিকা নিয়ে আলোচনা চলছে সেটার দামের কোনো প্রস্তাব আমরা এখনো পাইনি। আমরা আশা করি দ্রুতই টিকা পাব। সেজন্য রাত-দিন চেষ্টা করছি। কিন্তু চাহিদার তুলনায় টিকার সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা অ্যাস্ট্রাজেনেকার জন্য বেশি চেষ্টা করছি। যেখানে উৎপাদন হচ্ছে বা মজুত রয়েছে সেখান থেকে আনার চেষ্টা করছি।
রাশিয়ার প্রস্তাবিত ‘সাপ্লাই অ্যাগ্রিমেন্ট’র ওপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে ৩০টি সংশোধনী আনার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে টিকার মূল্য ছাড়া আরও আছে-দুটি ডোজের মধ্যবর্র্তী সময়ে (১ অথবা ২ মাস) নির্দিষ্ট থাকায় বিক্রেতা যদি ওই সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রথম ডোজ গ্রহণকারীর কোনো উপকার হওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই এ দায়িত্ব বিক্রেতাকেই বহন করতে হবে। এক্ষেত্রে চুক্তিতে প্রথম ডোজ সরবরাহের পর দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের নির্ধারিত সময়ের আগেই সেটি সরবরাহের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত।
প্রস্তাবিত চুক্তিপত্রের ৬.৪ ধারা উল্লেখ করে সংশোধনীর ১৭ নম্বরে বলা হয়েছে, কোনো চালানের পণ্যের গুণগত মান ঠিক না থাকলেও মূল্য পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। যা পুরোপরি বিক্রেতার পক্ষে যায়।
এ শর্তের পরিবর্তে প্রস্তাব করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব বিক্রেতার ওপর বর্তায়। এছাড়া চুক্তিপত্রে উভয়পক্ষকে ট্যাক্স পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে যে পক্ষ আয় করবে সেই পক্ষ অথবা প্রত্যেক পক্ষ নিজ নিজ দেশে ট্যাক্স-ভ্যাট পরিশোধ করবে-এ মর্মে শর্ত সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও রাশিয়ার ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অব রাশিয়া ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (আরডিআইএফ) মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল গোপনীয়তার চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ তৃতীয় পক্ষের কাছে কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করতে পারবে না। গোপন তথ্য হিসেবে ক্লিনিক্যাল ডেটা ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত এবং চুক্তির বিষয়বস্তুকে উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তির অনুলিপি মস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের হাতে দেওয়া হয়।
এর আগে ২৭ এপ্রিল দেশে রাশিয়ার টিকা স্পুতনিক-ভি-এর জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত জরুরি জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ওষুধ, পরীক্ষামূলক ওষুধ, টিকা ও মেডিকেল সরঞ্জামবিষয়ক কমিটি এই অনুমোদন দেয়। এখন রাশিয়ার এই টিকা আমদানি ও ব্যবহারে আইনগত বাধা নেই।
করোনার টিকা নিয়ে গঠিত কোর কমিটি রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি সংগ্রহের জন্য সুপারিশ করেছে। স্পুটনিক-ভি টিকার কার্যকারিতা ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ উল্লেখ করে কোর কমিটি বলেছে, এটি রাশিয়ার ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত। বিশ্বের ৬১টি দেশে এ টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে। দাম প্রতি ডোজ ১০ থেকে ২০ ডলার।
এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের তৎপরতা ঠিক আছে। তবে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের পেছনে না ছুটে আরও অন্তত দুই থেকে তিনটি সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। কারণ প্রথমে টিকার একটি সোর্সের ওপর নির্ভর করে যে ভুল হয়েছে, সেটি যেন আর না হয়।
তারা বলেন, টিকা প্রাপ্তির বিষয়টি কোনো ‘একশ মিটার দৌড় নয়, এটি ম্যারাথন দৌড়।’ কেননা একবার টিকা দিলেই আমাদের টিকার প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাবে না। তাই টিকা আনার বিষয়ে আরও যোগাযোগ করা উচিত।
‘স্পুটনিক-ভি’র প্রস্তাবিত দাম সম্পর্কে বলেন, টিকার মূল্য একটি সংবেদনশীল বিষয়। মূল্য অনেকটা নির্ভর করে কূটনৈতিক এবং প্রাপ্যতার ওপর। তবে তারা যে মূল্য প্রস্তাব করেছে, প্রায় একই মূল্যে তারা বিভিন্ন দেশে বিক্রি করেছে। তবে কূটনৈতিক তৎপরতায় দরকষাকষিতে মূল্য কমানোর সুযোগ থাকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ