আজ মহান ও ঐতিহাসিক মে দিবস। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক হিসেবে পয়লা মে সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ পালিত হয়। এ দিবসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। তবে তা নিয়ে আলাপের কোন ইচ্ছে নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মে দিবস শ্রমিকদের সাথে রাষ্ট্রীয় রসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। যে রাষ্ট্রে বেতন-ভাতার দাবি জানালে শ্রমিকদের অপরাধীর মতো গুলি করে মারা হয়, সে রাষ্ট্রের মে দিবস উদযাপনের কোন কারণ দেখি না। এছাড়া প্রতিবছর বাড়ছে কর্মস্থলে শ্রমিকের মৃত্যু। তবে তা নিয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যথা নেই। মালিক শ্রেণীর চাহিদামাফিক সুবিধা প্রদানেই তাদের সব চেষ্টাচরিত্র।
সম্প্রতি বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে পরপর দুদিন গুলি করেছে পুলিশ। এমনকি দ্বিতীয় দিনে প্রথম দিনের মতো ফাঁকা গুলি না করে সরাসরি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুলিশের গুলি চালানো ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। উপরন্তু এ ঘটনার পর শ্রমিকদের নামেই পুলিশ মামলা করে। গোটা সময়েই এক প্রকার চুপ ছিল মানবাধিকার সংস্থাগুলোও। কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। রাস্তায় সংঘবদ্ধ কোন আন্দোলন হয়নি।
সর্বংসহা হয়ে গেছে বাঙালি। লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষে শ্রমিকদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা না ক’রে দেশের পাটকল আর চিনিকল বন্ধ করে দে’য়া সরকারের সিদ্ধান্তের পর এই মে দিবসে শ্রমিকদের জন্য সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার বুক চাপড়ানো অনেকটা মাছের মায়ের পুত্র শোকের মতো।
অথচ দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী শ্রমবাজারে নিয়োজিত। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, তা প্রায় ছয় কোটি ৭০ হাজার। দেশের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ।
বাঁশখালীতে খুন হয়েছে দশ শ্রমিক
বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের নৈতিক আন্দোলনে বর্বরতার নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে এই এপ্রিলে অন্তত পাঁচজন শ্রমিক নিহত হয়েছে৷ আহত হয়েছে কমপক্ষে ২৫ জন৷ এমনটা করা কোনও গণতান্ত্রিক দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ারে নেই।
বাংলাদেশে দিনদিন পুলিশ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী। সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো এবং উপর্যুপরি মামলার ঘটনায় পুলিশ সিন্দাবাদের ভূতের মতো মানুষের কাঁধে চেপে বসেছে।
বাঁশখালীতে সম্প্রতি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া মজুরি ও রোজার দিনে কাজের সময় কমানোর দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের সাক্ষ্য বহন করে। কারণ কোনও দাবি দাওয়া নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ বা বিক্ষোভ হতেই পারে, সেটা থামানোর উপায় কখনও নিরীহ শ্রমিকদের উপর গুলি চালানো হতে পারে না।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকরা স্বাভাবিক কিছু দাবি তুলেছিলেন। যার মধ্যে ছিল বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং ইফতার ও সেহরির সময় ছুটি দেওয়া।
শ্রমিকদের এসব দাবি নিয়ে মালিকপক্ষের যদি কোনো আপত্তি থাকে, তা নিয়ে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা যেত। মালিকপক্ষ যে সে পথ ধরেনি, সেটা স্পষ্ট। সাধারণভাবে আমাদের দেশের শ্রমিকদের যে বেতন, তাতে মাস চালানো কঠিন। তারপর মাসের মাঝামাঝি এসেও যদি আগের মাসের বেতন না পান, তাহলে তারা কীভাবে চলবেন!
সূত্র মতে, নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের মধ্যেই পুলিশের একটি ক্যাম্প আছে৷ শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষ তাদের ন্যায্য আন্দোলন দমনে পুলিশকে ব্যবহার করে আসছে।
উল্লেখ্য, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে এটাই প্রথম প্রাণঘাতী ঘটনা নয়। ২০১৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকালে স্থানীয় লোকজন যখন এর বিরোধিতায় নেমেছিলেন, তখনও বিক্ষোভ দমনের সময় চারজন প্রাণ হারান।
১৩২০ মেগাওয়াটের ‘এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট’ নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১৬ সালে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষ বিরোধিতায় নামে। ওই পক্ষটি ও পুলিশের সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধীদের সংঘর্ষে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল প্রাণ ঝরে চারজনের। এছাড়া ১১ পুলিশসহ কমপক্ষে ১৯ জন আহত হন। এরপর সেই বিরোধের সমঝোতা বৈঠক ঘিরে ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আবার দুই পক্ষের সংঘর্ষ নিহত হয় একজন।
কর্মস্থলে শ্রমিকদের মৃত্যু
গত বছর দেশে কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৭২৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৩৪৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে পরিবহন খাতে। আর মৃত্যুর দিক থেকে নির্মাণ খাত দ্বিতীয় ও কৃষি খাতের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর পরিসংখ্যানে এ তথ্য জানা যায়।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৪৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে পরিবহন খাতে। নির্মাণ খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে কৃষি খাতে। এছাড়া দিনমজুর ৪৯ জন, বিদ্যুৎ খাতের ৩৫ জন, মৎস্য খাতের ২৭ জন, স্টিল মিলের ১৫ জন, নৌপরিবহন খাতের ১৫ জন, অভিবাসী শ্রমিক ১৫ জন ও ১৪ জন মেকানিকের মৃত্যু হয়েছে এই সময়ে। এর আগে, ২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২০০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল।
এছাড়া, গত ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজায় পোশাক তৈরি কারখানা ভবন ধসে পড়ে। এতে পাঁচটি পোশাক কারখানার এক হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। আহত হন সহস্রাধিক শ্রমিক। তাদের মধ্যে অঙ্গ হারিয়েছেন ২৭ জন। ২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারের পলাশবাড়ির শাহরিয়ার ফ্যাব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ ও স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজের ভবন ধসে ৬২ জন শ্রমিকের মৃত্যু, ২০১০ সালে ১ জুন তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ভবনধসে ২৫ জনের মৃত্যু, ২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টস ভবনে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১০০ শ্রমিকের মৃত্যু, আশুলিয়ার প্রাণকেন্দ্রের একটি ভবনধসে কয়েকজনের মৃত্যু এবং গাজীপুরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
বেড়েছে শ্রমিক আন্দোলন
বিলসের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় গত বছর (২০২০) শ্রমিক আন্দোলন বেশি হয়েছে। ২০১৯ সালে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল ৪৩৪টি। তবে গত বছর আন্দোলনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯৩।
গেল বছর সব থেকে বেশি সংখ্যক শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে তৈরি পোশাক খাতে, এ সংখ্যা ২৬৪।
এরপর শ্রমিক আন্দোলন বেশি হয়েছে পাটশিল্পে, ৪৯টি। এর বাইরে চিনিশিল্পে ৪৬টি, পরিবহন খাতে ৪৫টি, কৃষি খাতে ২৩টি, নৌ পরিবহন খাতে ১৯টি, অভিবাসী শ্রমিক ১৮টি এবং স্বাস্থ্য খাতে ১৫টি শ্রমিক আন্দোলন সংঘটিত হয়।
শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যের কারণ সম্পর্কে বিলসের প্রতিবেদন বলছে, বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকেরা সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৭৬টি আন্দোলন করেন।
বেকার হচ্ছে শ্রমিকেরা
একের পর এক বন্ধ হয়েছে কারখানা। বেকার হয়েছে শ্রমিক। করোনা মহামারিতে ছাটাই করা হয়েছে। বেতন পায়নি ঠিকমতো। এরপর বকেয়া বেতনের দাবি করলে রাষ্ট্র লেলিয়ে দিয়েছে পুলিশ।
বিলসের প্রতিবেদন বলছে, করোনায় তৈরি পোশাকখাতসহ অন্য খাতের শ্রমিকেরা প্রণোদনার আওতায় এলেও নির্মাণ শ্রমিকেরা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। নির্মাণশ্রমিকদের বড় অংশের এখন কোনো কাজ নেই।
এ ছাড়া গত বছর দেশে ছয়টি চিনিকল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন ৫ হাজার চিনিকল শ্রমিক। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও গ্র্যাচুইটি, ভবিষ্য তহবিল, আখের মূল্য ও সরবরাহকারীর বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৫৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। পাওনার দাবিতে প্রায়ই শ্রমিকেরা রাস্তায় নামছেন।
এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত সব পাটকল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ২৬ টি পাটকলে ২৪ হাজার ৮৬৬ জন স্থায়ী শ্রমিকের বাইরে তালিকাভুক্ত ও দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক ছিল প্রায় ২৬ হাজার। পাটকল বন্ধ করতে ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে নীলফামারীর সৈয়দপুরের ছয়টি বেসরকারি পাটকলের মধ্যে পাঁচটিরই উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন এসব মিলের প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক।
ন্যূনতম মজুরি নেই ৫৫ শিল্প খাতে
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই) থেকে দেশের সব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স নিতে হয়। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন এই সংস্থা এ পর্যন্ত ৫৪টি শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে। এর বাইরে বিবিধ তালিকায় আরও অন্তত ৫০টি শিল্প খাতকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।
এই ১০২টি শিল্পের মধ্যে মজুরি বোর্ড মাত্র ৪৭টি শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ এখনও বাকি ৫৫টি শিল্পের শ্রমিকরা ন্যূনতম ঘোষিত মজুরির বাইরে রয়েছেন।
মজুরি বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আরও তিনটি শিল্পের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ নিয়ে এখন কাজ চলছে।
করোনায় লকডাউনে শ্রমিকদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। নতুন করে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। পাটকল-চিনিকল বন্ধ করায় লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী এখন বেকার। শ্রমিক-মেহনতিদের ঘরে ঘরে হাহাকার। তাদের জন্য বরাদ্দ করা সামান্য টাকা নিয়েও চলছে দুর্নীতি। অথচ করোনার এই দুর্যোগেও শ্রমিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদনের চাকা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তাদের জীবন ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ নয়। লকডাউনে তিন-চার মাইল হেঁটেই তাদের অধিকাংশকে কারখানায় আসতে হয়। ন্যূনতম ঝুঁকিভাতাও তাদের কপালে জোটেনি। তবে বকেয়া বেতন বা ন্যায্য অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামলে, তাদের কপালে গুলি ঠিকই জুটবে এই রাষ্ট্রে।
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ