গত শুক্রবার ভারতে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ দৈনিক করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ে। ওই দিন ৩ লাখ ৩০ হাজার নতুন করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। রাজধানী নয়াদিল্লিসহ উত্তর ও পশ্চিম ভারতজুড়ে বেশির ভাগ হাসপাতাল অক্সিজেনের সংকটে ভুগছে। ভারতে করোনা ভাইরাসের এই তাণ্ডবের পেছনে রয়েছে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট। এটি অত্যন্ত মারাত্মক। এই ভ্যারিয়েন্টের চারদিকে সংক্রমণ করার ৩০০ গুণ ক্ষমতা রয়েছে।
নতুন এই স্ট্রেইনে আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থারও দ্রুত অবনতি ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো লাগাম পরানো না গেলে সংক্রমণের সুনামি ঘটবে।
ভারতের জিনোম বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের যে ‘ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট’ চিহ্নিত করেছেন, সেটি নিয়েও উদ্বেগ আছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই ডাবল মিউটেশনের কারণে ভাইরাসটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ফাঁকি দিতে পারে। টিকা তখন কাজ করে না।
বাংলাদেশে ভারত ফেরত করোনা রোগী
যশোর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মো. ইউসুফ আলী জানিয়েছেন, বেনাপোল বন্দরে ১ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের আসা যাত্রীদের ভেতর ২৯ জনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হয়। আক্রান্তদের বেনাপোল থেকে চিকিৎসার জন্য যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে পাঠানো হয়।
এদিকে, হাসপাতালটিতে কোভিড-১৯ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ভারত ফেরত ১১ রোগীর মধ্যে ১০ জন পালিয়েছেন বলে জানা যায়। এ নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক।
সোমবার (২৬ এপ্রিল) করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিশ্চিত করেছেন যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. দিলীপ কুমার রায়।
সূত্র মতে, ভারত থেকে এসে হাসপাতালে ভর্তির পর পালিয়ে যাওয়া সাত করোনা রোগীকে পুলিশ ধরেছে। তাদের যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এ ব্যাপারে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা জানার পর পুলিশ বেনাপোল ইমিগ্রেশন থেকে সাতজনের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে। এরপর স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় তাদের ধরা হয়। তাদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘ভারত থেকে আগতদের শরীরে কোন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট ছিল, সেটা পরীক্ষা করা হবে। সেটা জেলাতে করা সম্ভব নয়। যে জন্য তাদের নমুনা ঢাকাতে এনে পরীক্ষা করতে হবে।’
সুইজারল্যান্ডে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রথম রোগী
গত শনিবার সুইস ফেডারেল অফিস অব পাবলিক কোভিড-১৯-এর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রথম নমুনা সুইজারল্যান্ডে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে।
জানা যায়, ভারতীয় ভেরিয়েন্ট–বাহক এমন একজন যাত্রী, যিনি বিমানবন্দরে ট্রানজিটে ছিলেন। ওই বাহক যাত্রী একটি ইউরোপীয় দেশ থেকে সুইজারল্যান্ডে প্রবেশ করেছিলেন।
এদিকে, বর্তমানে কেবল সুইস নাগরিক বা আবাসনের অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভারত থেকে সুইজারল্যান্ডে প্রবেশের অনুমতি রয়েছে।
স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছে, মার্চের শেষের দিক থেকে ভারতীয় করোনাভাইরাসের রূপান্তর নিয়ে নমুনা প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়ামে
ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়ামে ভারতীয় রূপটি শনাক্ত হয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশগুলোতে।
গত বৃহস্পতিবার পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড (পিএইচই) জানায়, ভারতে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের যে নতুন ধরনটি পাওয়া গেছে, তাতে যুক্তরাজ্যে এ পর্যন্ত ৫৫ জন সংক্রমিত হয়েছে।
করোনার দৈনিক সংক্রমণের হারে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার পর ভারতের নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। গত শুক্রবার ভারতকে ‘লাল তালিকায়’ যুক্ত করে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়।
এদিকে, বেলজিয়ামের প্যারিসের চার্লস ডি গল বিমানবন্দর হয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আগত ২১ জন ভারতীয় শিক্ষার্থীর শরীরে ভারতীয় করোনাভাইরাস ভেরিয়েন্ট পজিটিভ ধরা পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তারা প্যারিস অঞ্চল থেকে বেলজিয়ামের যাত্রা চলাকালীন সম্ভবত তাদের গ্রুপের মধ্যেই ‘সুপার স্প্রেডার’–এর শিকার হয়েছেন।
ব্রিটেন, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারত থেকে বিমান নিষিদ্ধ করেছে।
ইতালিতে পাওয়া গেছে ভারতীয় ভ্যারিয়ান্ট
সোমবার (২৬ এপ্রিল) ইতালীয় কর্তৃপক্ষ নিজ দেশে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়ান্ট পাওয়ার খবরটি নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি ভারতে থেকে এক বাবা-মেয়ে ইতালিতে আসার পর তাদের শরীরে এই ভ্যারিয়ান্ট পাওয়া যায়। এর আগে গত মাসে ইতালির আরেক জায়গায় আরেকটি ঘটনা পাওয়া গিয়েছিলো। তখন থেকেই করোনা আক্রান্ত দেশগুলো সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ইতালি।
ভেনেটো অঞ্চলের প্রধান লুকা জাইয়া জানিয়েছেন, করোনা নিয়ে সদ্য আসা ভারতীয় বাবা-মেয়েকে আপাতত হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এদিকে ইতালির স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্তো স্পেরানজা গত রবিবার ঘোষণা দিয়েছেন, ভারতে ১৪ দিন ছিলো এমন কেউ কোন দেশ থেকে ইতালিতে প্রবেশ করতে পারবে না।
দুশ্চিন্তায় জার্মানি
গতকাল রোববার জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়ান স্পান বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের ভারতে পাওয়া নতুন ধরন আমাদের খুব চিন্তায় ফেলেছে।’
আর সেই সঙ্গে ভারতীয়দের জার্মানিতে আসার ব্যাপারে নানা কড়াকড়ির কথাও বলেছেন।
রোববার রাত থেকে ভারত থেকে আসা কেবল জার্মান নাগরিক এবং যাদের স্থায়ীভাবে জার্মানিতে বসবাসের অনুমতি রয়েছে, তাদেরই প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।
তবে জার্মানিতে প্রবেশের আগে এসব যাত্রীদের অবশ্যই একটি করোনার নেগেটিভ পরীক্ষা দেখাতে হবে। আর জার্মানি পৌঁছানোর পর ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিনে যেতে হবে।
জার্মানির সংক্রমণ রোগ বিষয়ের গবেষণা কেন্দ্র, রবার্ট কখ ইনিস্টিটিউটের সহসভাপতি লার্স স্ক্যাড গত শুক্রবার বলেছেন, বি.১.৬১৭ নামে পরিচিত ভারতীয় বিপজ্জনক ভাইরাসের রূপান্তর পর্যবেক্ষণ করা গেছে।
ইউরোপ জুড়ে আতঙ্ক
ইউরোপে ২৩ এপ্রিল বেলজিয়ামে প্রথমবারের মতো করোনার ভাইরাসের নতুন ভারতীয় রূপটি আবিষ্কৃত হয়।
বেলজিয়াম সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল, সিঙ্গাপুরসহ আরও কিছু দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ভারতীয় রূপটি পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে জার্মানিসহ আরও কয়েকটি দেশ আগামীকাল সোমবার থেকে ভারতের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে।
ভারতে করোনভাইরাস এই রূপান্তরকে বিশেষজ্ঞদের ভাষায় বি.১.৬১৭ বলা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এটি স্পষ্ট যে ভারতীয় ধরনটি সাধারণত মূল করোনভাইরাস থেকে বেশি সংক্রামক।
তবে এই সংক্রমণ ব্রিটিশ করোনার ধরনের চেয়ে আরও সহজেই সংক্রমণযোগ্য কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছে, ফ্রাঙ্কফুর্ট রন্ডসাউ পত্রিকাটি।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৫১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ