মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসংলগ্ন বনে আগুন লেগেছে। আজ শনিবার দুপুর ১টার দিকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘হিড বাংলাদেশ’-এর কার্যালয়ের পেছনের (বাঘমারা বন ক্যাম্পে) বনে এই আগুন লাগে।
ঘটনার খবর পেয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত হয়। তারা প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। কমলগঞ্জ উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলে ঢোকার রাস্তা না থাকায় ও পানির উৎস না থাকায় আগুন নেভাতে সময় লাগে। বেলা তিনটার দিকে আগুন নেভানো সম্ভব হয়।
গুরুত্বপূর্ণ এই বনে দুই ঘণ্টা ধরে আগুন জ্বললেও দুপুর ৩টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। আগুনে বন এলাকার ছোট-বড় গুল্ম ও গাছ পুড়ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রখর রোদে লাউয়াছড়ার স্টুডেন্ট ডরমেটরি অংশে গাছ রোপনের জন্য কাজ করছিলেন বন বিভাগের কিছু শ্রমিক। সেখানে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে। খবর পেয়ে বন বিভাগ ও কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের লোকজন ঘটনাস্থলে এসে তিন ঘন্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে পানি স্বল্পতা ও বনের ভেতরে রাস্তা না থাকায় ভেতরে ঢুকতে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে সময় লাগছিল। আগুনে বড় সাইজের কোন গাছ পুড়তে দেখা না গেলেও বনের লতা-গুল্ম, ছোট ছোট গাছ গাছালি পুড়ে গেছে। এতে বন্যপ্রাণীর ব্যাপক আবাসস্থল বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি বয়ে আনছে।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বনে আগুন দেখা যায়। মুহূর্তের মধ্যে আশপাশের এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনার খবর পেয়ে কমলগঞ্জ উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট গিয়ে আগুন নেভানোর কাজে যুক্ত হয়। লাউয়াছড়া বনের রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ বনকর্মীরা ঘটনাস্থলে যান বেলা দুইটার দিকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বন বিভাগের কয়েকজন শ্রমিক পাহাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজ করছিলেন। এতে তিনটি পৃথক টিলায় আগুন লেগে ক্রমেই তা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় সেখানে বিদ্যুতের একটি খুঁটিতে আগুন ধরে গেলে মানুষের মাঝে আতঙ্ক দেখা দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন।
ফায়ার সার্ভিস কমলগঞ্জের ইনচার্জ ফারুকুল ইসলাম জানান, গাছগাছালি পুড়ে প্রায় লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হবে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কারণে প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ অফিসার সহিদুল ইসলাম বলেন, আগামী বর্ষা মৌসুমে ওই স্থানে ফলজ ও বনজ গাছ লাগানোর জন্য জমি তৈরির কাজে হাজিরাভিত্তিক কিছু চা শ্রমিক নিয়োজিত করা হয়েছিল। তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল কোনো ধরনের আগুন না জ্বালানোর জন্য। বনে আগুন দিয়ে কাজ করার কোনো নিয়ম নেই। আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তদন্ত করে বের করা হবে বলে জানান তিনি।
কমলগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার নুরুল ইসলাম জানান, খবর পেয়ে তাদের ১০ জন কর্মী তিনটি ভাগ হয়ে আগুন নির্বাপণের কাজ করেন। কম সময়ে জঙ্গল পরিষ্কার করতে বনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা বললেও তিনি তদন্তে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে বলে সাংবাদিকদের জানান।
কীভাবে লাগল আগুন?
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এখানে কিছু অবৈধ দখলদার আছেন। ধারণা করা হচ্ছে, প্রচণ্ড খরতাপের সুযোগ কাজে লাগিয়ে এসব অবৈধ দখলদারেরাই আগুন লাগাতে পারেন। দেড় বছর আগেও এই বনে আগুন লেগেছিল।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেছেন, বন বিভাগের খামখেয়ালির জন্য এখানে বারবার আগুনের ঘটনা ঘটছে। এর ফলে শত শত একর বনভূমি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু বন বিভাগের পক্ষে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় বারবার আগুনের ঘটনা ঘটছে।
শ্রমিকেরা বলেন, এই এলাকায় নতুন করে গাছ লাগাতে তারা ঝোপঝাড় পরিষ্কার করছিলেন। তবে আগুন কীভাবে লেগেছে, তারা তা জানেন না বলে দাবি করেন।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র বলছে, এই এলাকায় নতুন করে গাছের চারা লাগানোর জন্য বনের টহল সদস্যদের একটি অংশ ছোট ছোট ঝোপঝাড় পোড়াতে হালকাভাবে আগুন লাগিয়েছিল। এটি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, তা তারা ভাবতে পারেননি।
এই আগুন লাগার ঘটনায় দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বন বিভাগ। এই কমিটিকে দুই দিনের ভেতরে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদি সরোয়ারের নেতৃত্বে কমিটির অন্য সদস্য বন মামলা পরিচালক জোলহাস উদ্দিন।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম ও লাউয়াছড়া বন বিট অফিসার মিজানুর রহমান ঘটনাস্থলে কিভাবে আগুন সূত্রপাত হলো তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। আগুনে লতা-গুল্মজাতীয় গাছগাছালি ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধিত হয়েছে বলে জানায় বন বিভাগ।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ফায়ার সার্ভিস ও বনকর্মীরা যৌথভাবে বনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। তবে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেও আগুন লাগাতে পারে অথবা কর্মরত শ্রমিকদের সিগারেটের আগুন থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। প্রায় দেড় একর জায়গার লতা-পাতা ও ছোট ছোট গাছগাছালি পুড়ে গেলেও বড় কোন গাছ পুড়েনি। তবে অগ্নিকান্ডের সঠিক কারণ উদঘাটন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য এ ঘটনায় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বনবিভাগ।
রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, আগুন কীভাবে লাগলো এবং কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পেলে আগুণের সূত্রপাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সিলেট বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম মুঠোফোনে জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, প্রায় দেড় বছর আগে এবারের ঘটনাস্থলের কাছে বনে আগুন লেগেছিল। ওই ঘটনার কোনো তদন্ত হয়নি। আজকে আবার আগুন লেগে বনের ক্ষতি হলো। এর দায় বন বিভাগকে নিতে হবে।
লাউয়াছড়া বনে
১২৫০ হেক্টর জমি নিয়ে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৯৬ সালে এটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উদ্ভিদ আর প্রাণীবৈচিত্রের আঁধার এই বন বিভিন্ন বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। বন বিভাগের হিসেব মতে, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড, ২ প্রজাতির কচ্ছপ), ২২ প্রজাতির উভচর, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও অসংখ্য কীট-পতঙ্গ রয়েছে। এই বনে বিরল প্রজাতির উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপড়া হনুমানও দেখতে পাওয়া যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ