প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়। খবর ইউএনবির
একিউআই মান ২০১ থেকে ৩০০ হলে, স্বাস্থ্য সতর্কতাসহ তা জরুরি অবস্থা হিসাবে বিবেচিত হয়। যার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে নগরবাসী। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ্য রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। আর একিউআই মান ৩০১ থেকে ৪০০ হলে শহরের বাতাসের মান মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’। ৪০১ থেকে ৫০০ হলে এটাকে ‘মারাত্মক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
একিউআই সূচকে ৫১ থেকে ১০০ স্কোর পাওয়ার মানে হলো বাতাসের মান গ্রহণযোগ্য। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর পাওয়ার অর্থ হচ্ছে বাতাসের মান অস্বাস্থ্যকর। এই সূচকে ৫০ এর নিচে স্কোর পাওয়ার মানে হলো বাতাসের মান ভালো।
শনিবার সকালে পাকিস্তানের করাচি ও ভারতের কলকাতা যথাক্রমে ১৭৩ ও ১৬৬ স্কোর নিয়ে তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিল।
বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি ধরনকে ভিত্তি করে- বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ এবং ওজোন (ও৩)।
ঢাকাবাসীর এই ভোগান্তি যে সত্যি অনেক বেশি মারাত্মক তা বোঝা যায় বায়ু দূষণের আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলো থেকে। সেগুলো বলছে, গত কয়েক বছর থেকে ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে চলেছে এবং ঢাকা পৃথিবীর দূষিততম নগরীগুলোর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে থাকছে। তাহলে ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণগুলো কী রকম?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে ইটভাটা, শিল্প কারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কালো ধোঁয়া, বস্তিতে প্রায় চল্লিশ লাখ চুলায় আবর্জনা, কাঠ-কয়লা ও কেরোসিন দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও দূরপাল্লার যানবাহনের ধূলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা খোড়াখুড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলার পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণের জন্য এখানকার বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র, যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন বিশ্ববিদ্যালয় ও রচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছেন। এতে বলা হয়, “বাংলাদেশে যে বায়ুদূষণ ঘটছে, তার অন্যতম কারণ আন্তঃসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ। ইরান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তানের শুষ্ক মরু অঞ্চল থেকে ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়। পশ্চিমা লঘুচাপের মাধ্যমে ওই ধূলিকণাসহ বাতাস ভারতে প্রবেশ করে। নভেম্বর থেকে ওই দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে।”
প্রতিবেদনটিতে পরিষ্কারভাবে আরও বলা হয়- “ভারতের কলকাতা, মুম্বাই, পাকিস্তানের করাচি ও বাংলাদেশের ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মারাত্মক যানজট ও ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সেখানে প্রচুর পরিমাণে ধূলাবালিও বাতাসে মিশছে। ফলে সামগ্রিকভাবে ওই শহরগুলো এই অঞ্চলের বায়ুকে দূষিত করে ফেলছে।”
২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যত শিশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল তাদের মধ্যে শতকরা ৪৯ ভাগ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর বাতাসে সাধারণত ধুলা ও দূষণ বেড়ে যায়
বায়ু দূষণের এই কুফল আমাদের স্বাস্থ্যের উপর আর কীভাবে প্রভাব ফেলছে এবিষয়ে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউড অ্যান্ড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. তানিয়া বলেন, “বায়ূ দূষণের জন্য শ্বাসকষ্ট ছাড়াও পেটের সমস্যা, ফুসফুস জনিত সমস্যা, চামড়ার সমস্যা, হাঁপানি বা এলার্জি জনিত সমস্যা, চোখ ও নাকের সমস্যা, যে কোনো সংক্রমণ, গর্ভকালীন সমস্যা এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ দূষণ খুব মারাত্মক প্রভাব ফেলে যা তাদেরকে সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং বায়ু দূষণ গবেষক ড. আব্দুস সালাম বলেন, “ঢাকা শহরে যে যানবাহনগুলো চলে সেগুলো বেশিরভাগই ব্যবহারের অনুপোযোগী। অনেকগুলো গড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ। গাড়িগুলোর যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেগুলো থেকে বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়। উন্নত বিশ্ব ‘কন্ট্রোল ওয়ে’তে দূষণ কমাচ্ছে। তারা পুরানো গাড়ি বাতিল করে দেয়। গাড়িতে তারা উন্নতমানের ইঞ্জিন ব্যবহার করে। আমরা নিন্মমানের ইঞ্জিন ব্যবহার করি। তারা গাড়িতে যে জ্বালানি ব্যবহার করে এর সালফারের মাত্রা ৫০ এর নিচে আমাদের দেশে সেই মাত্রা ২০০০-এর উপরে। তারা ভালো মানের জ্বালানি ব্যবহার করে। তারা ঠিকভাবে গাড়ির মেইনটেন্সেস করে, আমরা তা করি না। ফলে আমাদের গাড়িগুলো থেকে প্রচুর দূষণ হয়।”
শুধু তাই নয়, বিকল্প যানবাহন দূষণ কমায়। ট্রাম বিদ্যুতের মাধ্যমে চলে। মেট্রোরেল ও ইলেকট্রিক কার দূষণ কমায় বলে তিনি জানান।
আরও বলেন “এখানে কোনো নিয়মনীতি ছাড়া একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণ কাজ চলতে থাকে। এ কাজে ব্যবহৃত কাঁচামাল ওখানেই তৈরি হয় এবং তা ঢেকে রাখা হয় না। উন্নত বিশ্বে নির্মাণ কাজ অনেক যত্ন এবং কম সময় নিয়ে করা হয়। কাঁচামালগুলো অন্য জায়গায় তৈরি করা হয়। এখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয় সারা বছর ধরে এবং মাটিগুলো রাস্তার পাশেই রাখা হয়। ওগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে গার্মেন্টস এবং শিল্প কারখানাগুলোর বর্জ্য থেকেও দূষণ ছড়ায় ব্যাপকভাবে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।”
তিনি বলেন, ঢাকার আশেপাশে প্রচুর ইটভাটা রয়েছে এবং সেগুলো দূষণের জন্য কঠিনভাবে দায়ী। অনেক দেশে ইটভাটা নেই। তারা সিমেন্টের তৈরি ব্লক ব্যবহার করে। আমরাও ব্লক ব্যবহার করতে পারি। আমাদের এখানে “ইনডোর এয়ার পলুশন” বেশি হয়। আমরা স্বাস্থ্যসন্মত রান্নাঘর ব্যবহার করি না বলে আমাদের রান্নাঘর থেকেও প্রচুর বায়ুদূষণ হয়। এসব বিষয়ে যদি আমরা সচেতন হই তাহলে দূষণ কম হবে। কাজগুলো অল্প অল্প করে শুরু করতে হবে। এ জন্য সরকারি পর্যায় থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
শুধু স্থানীয়ভাবে ঢাকায় বায়ুদূষণ কমালে কাজ হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এ জন্য তারা আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণ বন্ধ করার বিষয়ে আঞ্চলিকভাবেও উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে সকলকে আগ্রহী হতে বলছেন। নইলে এই অঞ্চলের কোনো দেশের বায়ু দূষণমুক্ত হবে না বলে জানান তারা। তাই দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে বলে দৃঢ় মত প্রকাশ করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩১
আপনার মতামত জানানঃ